World

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান -রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের ভবিষ্যত কোন পথে?

ফারসি শব্দ “coup de etat” বাংলায় যার আভিধানিক অর্থ “বেআইনি বা জবরদস্তিমূলক শাসন পরিবর্তন”। এককথায় বলা যায় আকস্মিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে  অবরোধ করা। গত ৩১শে জানুয়ারি, ২০২১ মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান হলো। রোহিঙ্গা সমস্যার জন্য বাংলাদেশও তাই এখন ব্রহ্মদেশ খ্যাত মিয়ানমারের মতি গতি জানতে ব্যতিব্যস্ত। কি অপেক্ষা করছে রোহিঙ্গা ইস্যুর জন্য? 

প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সবার আগে একবার মিয়ানমারের জনসংখ্যার ওপর চোখ বুলানো যাক। জনসংখ্যার দিক দিয়ে মিয়ানমার বিশ্বের ২৪তম দেশ। জনসংখ্যা প্রায় ৬কোটি। জনসংখ্যার দিকে তাকালে ৮৭% বৌদ্ধ, ৬%খ্রিষ্টান, ৪.৩% মুসলিম এবং বাকিঅংশ হিন্দু, নাস্তিক এবং উপজাতি মুসলিম সম্প্রদায়। উপজাতি মুসলিমদের অধিকাংশই বর্মী মুসলিম, যারা ইয়াঙ্গুনে বসবাস করেন। উপজাতি মুসলিমদের মধ্যে রোহিঙ্গা রয়েছে রোহিঙ্গা, পান্তুই, মালয় ও জেরবাদী মুসলিম। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত চারটি বহুদলীয় নির্বাচন দেখেছে মিয়ানমার কিন্তু তিন প্রধান উপজাতির সাথে কখনোই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি।

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান

যাহোক, ২০১১সালের পর এটি ছিল মিয়ানমারের দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন। নভেম্বরের নির্বাচনের পর  ২ফেব্রুয়ারি ২০২১, সোমবার এই প্রথম মিয়ানমারের পার্লামেন্টের সাধারণ অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। ঠিক তখনই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলো। নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সুচির এনএলডি(ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি) ৮৩% আসন পেয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যার অভিযোগ সত্ত্বেও দলটি মিয়ানমারে বিপুলভাবে জনপ্রিয়। নির্বাচনের ফলও তেমনই প্রকাশ করছে।

কিন্তু এই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি(ইউএসডিপি)। ভোটে তারা খুব সামান্য অংশ পায় কিন্তু তারপরেও সামরিক বাহিনী এখনো মিয়ানমার সরকারের ওপর ব্যাপক প্রভাব রাখতে সক্ষম।

এবং এই প্রভাবের কারণ ২০০৮সালে সামরিক শাসনের সময় যে বিতর্কিত সংবিধানটি তৈরি হয়েছিল সেটা। এতে সামরিক বাহিনীকে পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন দেওয়া হয়। তার সাথে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণও তুলে দেওয়া হয় সামরিক বাহিনীর হাতে। অর্থাৎ সেই সংবিধান যতোদিন আছে, ততোদিন সামরিক বাহিনীর হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও থেকে যাচ্ছে। একরকম বলা যায়, পর্দার অন্তরালে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারের প্রধান কর্তা। 

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান

রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর এতো অত্যাচার যখন বিশ্বের কাছে ফাঁস হয়ে যায়, তখনো জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে সামরিক বাহিনীর নৃশংস গণহত্যাকে নাকচ করে দেন। একে সহিংসতা বলে উল্লেখ করেন তিনি। রোহিঙ্গারা মোট জনসংখ্যার ১.৩%। বাকি মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের খবর তেমন শোনা না গেলেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। অনেকে ধর্মকে মূল কারণ করলেও, রোহিঙ্গা নির্যাতনের মূখ্য বিষয় বর্মী এবং রোহিঙ্গাদের বৈরীতার পূর্ব ইতিহাস।

প্রশ্ন আসতে পারে…রোহিঙ্গা কারা?এককথায় বলতেই পারেন আরাকানের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। কিন্তু আজ একটু বিশদভাবেই জানা যাক। বর্তমানের রোহিং(আরাকানের পূর্ব নাম) এলাকায় ছিল এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভূগোল বলে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কী, মোঘল, অ্যারাবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছিলেন।

এজন্য আমরা রোহিঙ্গাদের কথায় চট্টগ্রামের স্থানীয়দের উচ্চারণের প্রভাব দেখতে পাই। তাদের কথ্যভাষায় কিন্তু  উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে খুব প্রচলিত একটি ধারণায় বলা হয়, সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে একটি জাহাজ ডুবে যায়। এই জাহাজ থেকে যারা সাঁতরে আরাকান উপকূলে আশ্রয় নেয়, তাদেরকেই রোহিঙ্গা বলে মনে করা হয়।

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান

ইতিহাস বলে ১৪৩০-১৭৪৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ২২হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাজ্য ছিল। এরপর বর্মী “বোদওফায়া” যখন এই রাজ্য দখল করে, তখন থেকেই শুরু হয় রোহিঙ্গা নির্যাতন। এরপর ব্রিটিশরা উপনিবেশ স্থাপন করে। তারা ১৩৯ টি নৃ-গোষ্ঠীর তালিকা করলেও বাদ পড়ে রোহিঙ্গারা। সেই ভুলের খেসারতে রোহিঙ্গা নির্যাতন চলছে যুগের পর যুগ ধরে।

মাঝখানে ১৯৪৮সালে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন এই নির্যাতন অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ ক্ষমতাসীন সরকারের উচ্চপদস্থে রোহিঙ্গাদের স্থান ছিল। ১৯৬৮সালে “নে উইন” এর সামরিক অভ্যুত্থানের পর আবারও শুরু হয় রোহিঙ্গা নির্যাতন।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। তাদের জাতিগত অধিকার নেই, শিক্ষার অধিকার নেই, মানবিক অধিকার নেই, এমনকি নেই বিয়ে করার বৈধতা বা সন্তান জন্ম দেওয়ার অধিকার। অথচ প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার তারা। রোহিঙ্গাদের  ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ সহ অমানবিক নির্যাতন চালায় সামরিক বাহিনী। সইতে না পেরে অনেক রোহিঙ্গা সাগরপথে বাংলাদেশে আসতে থাকে।

এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার মানবতার খাতিরে সীমান্ত খুলে দেয়। ২৫শে আগস্ট ২০২০ মিয়ানমারের রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ৩বছর পূর্ণ হয়। রোহিঙ্গা সমস্যা আন্তর্জাতিক হলেও ভার সামলাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বলা যায় একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। একাধিকবার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে প্রত্যাবাসনে আগ্রহ দেখালেও কার্যত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার।

সর্বশেষ নির্বাচনেও রোহিঙ্গাদের ভোটের সুযোগ দেয়নি দেশটি। অন্যদিকে সীমান্ত খুলে দিয়ে ১১লাখ রোহিঙ্গার ভারে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশ। জাতিসংঘের প্রস্তাবনায় পাশে পায়নি চীন বা ভারতের মতো বন্ধুরাষ্ট্রকেও। চীন বরং মিয়ানমারের পাশেই ছিল সবসময়। 

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান রোহিঙ্গাদের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে?

মিয়ানমারের এই সামরিক অভ্যুত্থানে তাই সবার মনেই প্রশ্ন এবার তাহলে কি হবে রোহিঙ্গাদের?  অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।  সেই সাথে আশা করা হয় প্রতিবেশী দেশের সাথে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন…রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুই দেশের সরকারের সাথে আলোচনা হয়েছে।

কোনো ব্যক্তিবিশেষের সাথে নয় তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে জানান তিনি। এছাড়া ইতিহাসের উদাহরণ টেনেও তিনি বলেছেন “এর আগেও এই সেনা সরকারের অধীনে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়েছিল। কাজেই প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা চলছে। সেটা কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে গেলেও আটকে যাবে না।”

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জন্য সংবিধানের বর্তমান অবস্থা সুবিধাজনক। তাদের কমান্ড কাঠামোর সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আছে। বাণিজ্যিক স্বার্থের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আছে। সব থেকে বড় কথা যুদ্ধাপরাধের হাত থেকে বাঁচার রাজনৈতিক সুরক্ষাও আছে। সেনাবাহিনীর হাত ধরেই রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট কিভাবে সমাধানের মুখ দেখবে সেটাই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। 

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান

এ পর্যন্ত জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ২ টি ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটি ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর আর দ্বিতীয়টি একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর। চীন সবসময় মিয়ানমারের পক্ষেই ভোট দিয়েছে কিন্তু ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে ভারত। দ্বিতীয় দফা ভোটে বাংলাদেশ আরো ৯ টি দেশের ভোট পায়। আন্তর্জাতিক সাহায্য সহযোগিতা চললেও বলা যায় রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে একাই হাঁটছে বাংলাদেশ।

এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোও সাথে নেই। অথচ রোহিঙ্গা সংকট  একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। শত শত রোহিঙ্গা নারী ও কন্যাশিশুকে ধর্ষিত হয়েছে যার ৮২% এর সাথে জড়িত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জনগণের ওপর হুমকি স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।অভ্যুত্থানের আগেও তাদের মধ্যে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের আগ্রহ দেখা যায়নি। তারা ৫দফা শর্ত প্রদান করে বসে আছে।

অথচ এর এই ৫টি শর্তের কোনোটিই এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি মিয়ানমার। মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানে ১বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন নির্বাচনের পর আবার কোন সরকার ক্ষমতায় আসবে রোহিঙ্গাদের ওপর কি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেটার জন্যই এখন অপেক্ষা।

ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে একটি আর্টিকেল আছে চাইলে পড়ে নিতে পারেন। ধন্যবাদ।

5/5 - (13 votes)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button