রূপকথা

ফিনিক্সঃ এক রহস্যময় পাখির গল্প

4.9/5 - (9 votes)

ছোটবেলায় হ্যারি পটার মুভি দেখে বিস্ময়ে অবিভূত হয়নি এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম। হ্যারি পটার, প্রফেসর ডাম্বলডোর, টম রিডল, সেভেরাস স্নেইপ, রন উইজলি, হারমোনি গ্রেঞ্জার এই চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করেই কেটেছে আমাদের অনেকের বাল্যকাল। এমন অনেককেই পাওয়া যাবে যাদের হ্যারি পটার সিরিজের সব মুভিগুলো বেশ কয়েকবার করে দেখা।

তো সেখানে আমরা ফনিক্স পাখি নামে ডাম্বলডোরের চেম্বারে এক পাখির দেখা পাই। যে পাখি চেম্বার অব সিক্রেটে হ্যারি পটারের কাছে গ্রিফিন্ডরের তলোয়ার পৌছে দিয়েছিল, টম রিডলের সাপ বসলিস্কের চোখ অন্ধ করে দিয়েছিল এবং তার অশ্রু দিয়ে হ্যারি পটারের জীবন রক্ষা করেছিলো। আমরা দেখেছি ডাম্বলডোরের চেম্বারে ফিনিক্স পাখি নিজেকে নিজে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং সেই ছাই থেকেই আবার জন্ম গ্রহণ করেছে। হ্যাঁ, ফিনিক্স পাখি নিয়েই আজকে আমার এই আর্টিকেল।

ফিনিক্স পাখি
ফিনিক্স পাখি

পুরাণের এক অতি রহস্যময় পাখি এই ফিনিক্স। কথিত আছে সূর্যের আলো থেকে জন্ম নেওয়া এই পাখির পাখা গুলো তৈরি হয় রংধনু থেকে। আগুন রাঙা এই পাখি যুগের পর যুগ থেকেছে এক রহস্যের আবরণে। তার চোখের পানিতে আছে মানুষের শরীরের ক্ষত সারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। প্রাচীন অনেক রাজারা অমর হবার জন্য এই পাখির খোজ চালিয়ে গেছেন বছরের পর বছর। কিন্তু সফল হতে পারেননি কেউ।

ফিনিশীয় সভ্যতার লোকেরাই সর্বপ্রথম এই ফিনিক্স পাখির কথা সামনে নিয়ে আসেন। বর্তমান সিরিয়া ও লেবাননের পশ্চিম উপকূলে ছিল প্রাচীন ফিনিশীয় সভ্যতার অবস্থান। ধারণা করা হয় সিরিয়ার “ফিনিশীয়া” উপকূলের নামকরণ হয় এই ফিনিক্স পাখি থেকে। এই ঘটনা আমরা একটু পরেই বর্ণনা করবো। তবে ফিনিশীয় সভ্যতার কথা বলতে গেলেই বলতে হয় তাদের এক বড় কীর্তির কথা।

এই ফিনিশীয়রাই মিশরীয় চিত্রলিপি থেকে ২২টি চিহ্ন নিয়ে এক বর্ণমালা তৈরি করে যার সাথে গ্রীকরা স্বরবর্ণ যোগ করে ২৪টি বর্ণের বর্ণমালা তৈরি করে যা থেকে পৃথিবীর সকল বর্ণমালা তৈরি হয়। আমাদের বাংলা বর্ণমালাও অনেকাংশে গ্রীক ও ফিনিশীয় বর্ণমালার কাছে ঋণী।

শুধু ফিনিশীয় নয় গ্রীক, মিশরীয় এবং চাইনিজ পুরাণেও উল্ল্যেখ আছে এই ফিনিক্স পাখির। গ্রীক পুরাণ অনুসারে ফিনিক্স পাখি এক বিশাল আকৃতির দীর্ঘায়ু পাখি। যা ৫০০ বছর বাঁচে। কোথাও আবার ১০০০ বা ১৪০০ বছরের কথাও উল্ল্যেখ আছে। এই পাখির রঙ নিয়েও রয়েছে ভিন্নমত। কেউ বলেন এই পাখি দেখতে অনেকটা ময়ূরের মত আবার কেউ বলেন লাল পা হলুদ চোখের পাখি।

রোমান লেখক ল্যাক্টানশিয়ারের মতে এই পাখির পা লাল-হলুদ পালক দ্বারা আবৃত এর চোখ নীলকান্তমনির মত। কিন্তু ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস বলেছেন, এর রঙ লাল সাথে হলুদ ক্ষেত্র বিশেষে সোনালী। তার মতে এই পাখি ঈগল এর মত দেখতে আবার ল্যাক্টনশিয়ার বলেন উটপাখির মত ফিনিক্সের আকৃতি।

তবে আকৃতি বা রঙ যাই হোক না কেন এই ফিনিক্স পাখি চিরদিন বিখ্যাত হয়ে থাকবে তার মৃত্যু এবং জন্ম রহস্য নিয়ে। ৫০০ বা ১০০০ বা ১৪০০ বছর পরে এই পাখি মৃত্যু বরণ করে নিজেকে এবং নিজের বাসাকে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে এবং সেই ছাই থেকেই আবার পুনরায় জন্ম নেই রুপকথার এই রহস্যময় পাখি।

ফিনিক্স পাখি ২
ফিনিক্স পাখি

গ্রীক পুরাণের হেলিওসের কথা হয়ত আমরা অনেকেই শুনেছি যার মানে হচ্ছে সূর্য তার বাস ছিলো হেলিওপোলিসে। অনেকে মনে করেন ফিনিক্স পাখি সেখানেই থাকে। আবার অনেকে মনে করেন সূর্যের পিছনে বহুদূরে প্যারাডাইস আর সেই প্যারাডাইসের পাখি ফিনিক্স। গ্রীক পুরাণে বলা আছে ফিনিক্স পাখি কুয়োয় নেমে ভোরবেলা গান গাইতে গাইতে স্নান করতো আর তার সেই সমধুর কন্ঠের গান শোনার জন্য সূর্যদেবতা অ্যাপোলো তার রথ থামিয়ে দিতেন। আর এই কুয়োর অবস্থান ছিল আরব দেশে। সেই কুয়োর পাশে বাস করতো ফিনিক্স।

ফিনিক্স পাখির মৃত্যু ও পূণর্জন্মের গল্প

ফিনিক্সের মৃত্যু ও পূণর্জন্ম নিয়ে তিনটি গল্প প্রচলিত আছে। একটা গল্প নিয়েই আমরা বিস্তারিত বলবো। যেটা সবচেয়ে জনপ্রিয়। দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করার পর ফিনিক্স যখন বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পরে তখন সে বুঝতে পারে তার সময় শেষ এবং নতুন আরেক ফিনিক্সকে জন্ম দিতে হবে। তখন সে তার মৃত্যুর জন্য বেছে নেয় পৃথিবীকে।

প্যারাডাইস থেকে সে তার পৃথিবীর উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করে এবং প্রথমেই প্রবেশ করে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের ঘন জঙ্গলে এবং সেখান থেকে ভারত হয়ে আরব দেশে আসে। আরব দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের মশলা এবং লতা নিতো সে। সবচেয়ে বেশি পরিমানে যেটা নিতো সেটা হচ্ছে দারুচিনি। এগুলো দিয়ে সে তার বাসা তৈরি করতো সিরিয়ার ফিনিশীয়া উপকূলে। যেটার কথা আমরা আগেই বলেছি।

তো সেখানে তালগাছের উপর সে সুগন্ধী দারুচিনি দিয়ে তার বাসা তৈরি করে সূর্যদয়ের অপেক্ষা করতো। যখন সূর্যদেব পূর্বদিক থেকে তার রথ নিয়ে আসতো তখন ফিনিক্স পাখি এক বিষন্ন গান ধরতো তার সুমধুর কন্ঠে। সেই গান শুনার জন্য সূর্যদেব তার রথ থামিয়ে দিতেন। ভুলে যেতেন তার দায়িত্ব। বিমোহিত হয়ে পরতেন সেই সুরে। যখন সূর্যদেব বুঝতে পারেন তার দেরি হয়ে গেছে তখন তার ঘোড়ার পিঠে চালান চাবুক।

দ্রুত বেগে ছুটতে শুরু করে ঘোড়া আর সেই ঘোড়ার খুর থেকে আগুনের স্ফুলিঙ এসে পরে ফিনিক্সের উপর আর জ্বালিয়ে দেয় রূপকথার সবচেয়ে রহস্যময় পাখিটিকে সাথে তার বাসা। সেই সাথে শেষ হয় হাজার বছরের এক রহস্যময় জীবনের। পুড়ে ছাই হয়ে পরে থাকে রূপকথার ফিনিক্স পাখি। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, তিনদিন পরে সেই ছাই থেকে জন্ম হয় নতুন ফিনিক্সের।

আবারো শুরু হয় হাজার বছরের দীর্ঘ পথচলা। এই নতুন ফিনিক্স গন্ধরস দিয়ে তৈরি এক ডিম্বাকৃতির পাত্রে তার পূর্বসুরির দেহাবশেষ নিয়ে উড়াল দেয় প্যারাডাইসের উদ্দ্যেশে।

আর যে দুটি গল্প আছে তার একটির মতে, ফিনিক্স ফিনিশীয়া যায় না। হেলিওপলিসের এক অগ্নিকুন্ডে ঝাপ দিয়ে আত্মহুতি দেয় আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় নতুন ফিনিক্স। অন্যটির মতে, ফিনিশীয়া উপকূলে আসার পরে সে মৃত্যুবরণ করে এবং তার দেহ পচতে শুরু করে এবং তৃতীয় দিনে সেই পচন ধরা দেহ থেকে জন্ম নেয় নতুন ফিনিক্স।

মিশরীয় পুরাণের ফিনিক্স বেণু

মিশরীয় পুরাণে ফিনিক্স এর পরিচয় বেণু নামে। মিশরীয়দের কাছে বেণু ছিলো অমরত্ব ও পুনর্জন্মের প্রতিক। মিশরীয়রা অমরত্ব লাভের আশায় বেণুর পূজা করতো। বেণু ছিল দেখতে অনেকটা সারস পাখির মত। তার রঙ ছিল লাল ও সোনালী। সে ছিলো স্ত্রী পাখি।

বেণুর পূজা করার আরেকটা কারণ আছে মিশরীয়দের মধ্যে। নীল নদে বন্যা হলে তার পাশের প্লাবিত অঞ্চলে বন্যা পরবর্তী সময়ে প্রচুর ফসল ফলতো। প্রচন্ড খরার পরে যেহেতু গরম হতো এবং তার পরে বন্যা হতো এবং জমি উর্বরতা ফিরে ফেতো সেহেতু সেই চক্রের সাথে বেণুর মৃত্যু ও পূণর্জন্মের সম্পর্ক আছে বলে ভেবে বেণুর পূজা করতো মিশরীয়রা।

অন্যান্য পুরাণের ফিনিক্স পাখি

অন্যান্য পুরাণের ফিনিক্স
অন্যান্য পুরাণের ফিনিক্স

হিন্দু পুরাণের ‘গড়ুর’-কেও কেউ কেউ ফিনিক্সের সাথে তুলনা করেন। যে ছিলো বিষ্ণুর বাহন। গড়ুর পাখি স্বর্গ থেকে অমৃত আহরণ করে সেই অমৃত নিজে এক ফোটাও পান করেনি। তাকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্রও পরাজিত করতে পারেননি।

চৈনিক পুরাণের ফিনিক্স ফেং হুয়াং নামে পরিচিত। ফেং হুয়াং ছিলো সূর্য এবং নারী জাতির প্রতিক। ফেং হুয়াং এর গঠনও অদ্ভুত। মোরগের ঠোট, আবাবিল পাখির মুখ, সাপের মত ঘাড়, কচ্ছপের মত পিঠ আর মাছের মত লেজ ছিলো ফেং হুয়াং এর।

ফিনিক্স কিংবা রেণু, গড়ুর কিংবা ফেং হুয়াং যে নামেই ডাকা হোকনা কেন। ফিনিক্স বরাবরই মানুষের কাছে রহস্যময় পাখির নাম। যে পাখির অশ্রু অমরত্ব দান করতো, যে পাখি ছিল সৈভাগ্যের প্রতিক, যে পাখি নিজেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহুতি দিতো আবার সেই ছাই থেকেই জন্ম দিতো নতুন ফিনিযের।

রূপকথার ফিনিক্স পাখি স্থান করে নিয়েছে আধুনিক কালে সাহিত্য থেকে চলিচ্চিত্র, রাতের উঠানে দাদুর মুখের গল্প থেকে বন্ধুদের আড্ডায়। এভাবেই হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে ফিনিক্স, বেঁচে থাকবে ফিনিক্স।

গ্রিক পুরানের একটি অসাধারণ গল্প আঁধারে ফোটা নার্সিসাস আমাদের ওয়েবসাইট থেকে পড়ে নিন।

তথ্যসূত্র ও ছবিঃ ইন্টারনেট।

zahid

A professional SEO Expert & Digital Marketing Consultant. Enhancing online visibility of business is my job. Keeping update myself with new search algorithm update and stay top on search results is my passion.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button