সিঙ্গাপুরঃ মালয় উপদ্বীপের নিকট স্বপ্নের শহর
ধরুন, জীবন সম্পর্কে তীব্র বিতৃষ্ণা থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন আত্মহত্যা করবেন। করতে গেলেন, কিন্তু কোনো কারণে হলো না। অতঃপর দেখলেন পুলিশ এসে আপনার সরল মনকে অপরাধী করে নিয়ে জেলে ভরে দিয়েছে। এই অবস্থায় নিশ্চিতভাবে আপনার অবস্থান সিঙ্গাপুর! আত্মহত্যার চেষ্টা করা সিঙ্গাপুরে আইনবিরুদ্ধ কাজ। দেশটির সংবিধানের পেনাল কোড ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে যেতে হয় কারাগারে। মরে গেলে তো গেলেনই কিন্তু আত্মহত্যা চেষ্টায় ব্যর্থ হলে কারাগার আপনাকে নিমন্ত্রণ জানাবে। তাই সাবধান।
সিঙ্গাপুর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। মালয় উপদ্বীপের নিকটে অবস্থিত স্বপ্নশহর সিঙ্গাপুর। এর সরকারি নাম সিঙ্গাপুর প্রজাতন্ত্র ( Republic of Singapore)। ১৯৫৭ সালে মালয়েশিয়া ব্রিটেনের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের সাথে থাকতে চায়নি বলে ১৯৬৫ সালে পৃথক করে দেয় সিঙ্গাপুরকে। সিঙ্গাপুর এভাবে স্বাধীনতা চায়নি। তারা চেয়েছিল মালয়েশিয়ার সাথে থাকতে। তাই তারা এই সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টও ছিল। এভাবেই অসন্তুষ্টির হাত ধরে তারা শুরু করেছিল তাদের পথচলা। আমাদের স্বাধীনতার মাত্র ৬ বছর আগে তারা স্বাধীন হয়েছিল। আর আজ তারা বিশ্ব-অর্থনীতিতে অন্যতম একটি সমৃদ্ধশালী দেশ।
সিঙ্গাপুরের নামকরণও মালয়েশিয়ার সাথে সম্পর্কিত।”সিঙ্গাপুর” নামটি আসে মালয় ভাষার ‘Singapura’ সিঙ্গাপুরা থেকে। আবার সিঙ্গাপুরা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা সিঁহাপুরা থেকে, যার বাংলা অনুবাদ সিংহপুর। এখানে মজার কথা হলো সিংহশহর বলা হলেও আসলে সিঙ্গাপুরে সিংহ নেই। যেমন, বিরিয়ানিতে নেই বিড়ি!
সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ মিলিয়ন। এর মধ্যে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। জনসংখ্যার দিকে তাকালে জনসংখ্যা অনুপাত…বৌদ্ধ ৩৩.২%, খ্রিস্টান ১৮.৮%, ১৮.৫% যাদের কোনো ধর্ম নাই, ১৪%মুসলমান, ১০%তাওবাদী এবং লোকধর্ম, ৫% হিন্দু এবং বাকি ০.৬% অন্যান্য ধর্মের।
এদেশের সংস্কৃতি পশ্চিমা ঘরানার হলেও এখানে গোঁড়া হিন্দুবাদ, গোঁড়া খ্রিষ্টানবাদ , গোঁড়া ইসলামবাদ (মালয় সংস্কৃতি) এবং গোঁড়া বৌদ্ধবাদ (চাইনিজ সংস্কৃতি) আছে। বলে রাখা ভালো এদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী “হালিমাহ ইয়াকুব” একজন মুসলমান।পশ্চিমা ঘরানার সংস্কৃতির দেশ হলেও এদেশের প্রধানমন্ত্রী হিজাব পরিধান করে দেশ পরিচালনা করেন, যা সত্যিই ভালো লাগার মতো।
সিঙ্গাপুরের ৪টি দাপ্তরিক ভাষা রয়েছে।প্রধানত ইংরেজি ব্যবহার হলেও, এর সাথে আরো কয়েকটি ভাষা ব্যবহৃত হয়। এগুলি হলো: ইংরেজি, মালয়, চীনা মান্দারিন এবং তামিল। সাধারন ভাষা হিসেবে এখানে ইংরেজিই প্রচলিত। তাই এদেশের শতকরা ৮০% মানুষ সাধারণত ইংরেজিতে কথা বলে। এছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও সরকারি কর্মকান্ডে প্রধানত ইংরেজিই ব্যবহৃত হয়।।মালয়েশিয়া ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর সরকার মালয়কে জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। সিঙ্গাপুরের জাতীয় সঙ্গীতও মালয় ভাষাতেই রচিত।
সিঙ্গাপুরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রধানত রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা বহির্বিশ্বে প্রশংসিত। একই সাথে বেসরকারি উদ্যোগ এবং অবস্থানও সেখানে স্বীকৃত। তবে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার পূর্বে অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিবন্ধিত হতে হয়। এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা ইংরেজি মাধ্যম।সিঙ্গাপুরে ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যার মধ্যে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং নানইয়াং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি বিশ্বের সেরা ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম। মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বিশ্বব্যাপী সিঙ্গাপুরের সুনাম রয়েছে।
সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারের প্রধান। দেশটিতে মূলত একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেশি। দেশের নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকার ও আইনসভার দায়িত্বে পড়ে।বিচার বিভাগ নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন বিভাগ থেকে
স্বাধীন। আইনসভার সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান হলেও তার ভূমিকা মূলত আলংকারিক বা বলা চলে নামমাত্র। তবে ইদানিং
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিসর কিছু বাড়ানো
হয়েছে।১৯৫৯ সালের নির্বাচন থেকে সিঙ্গাপুরের
রাজনীতিকে পিপল্স অ্যাকশন পার্টি নামের রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। একাধিক
বিরোধী দল উপস্থিত থাকলেও ক্ষমতায় তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। তাই অনেক বিদেশী পর্যবেক্ষক সিঙ্গাপুরকে কার্যত একটি এক-দলীয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করে থাকেন।
সিঙ্গাপুর একটি ক্ষুদ্র ও ব্যাপকভাবে নগরায়িত দ্বীপরাষ্ট্র।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে সিঙ্গাপুর বহুদিন ধরেই এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশ। সিঙ্গাপুর সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য হলো সিঙ্গাপুরকে বলা হয় সিংহের শহর বা লায়ন সিটি। অথচ বাস্তবে গোটা সিঙ্গাপুরে সিংহের দেখা মেলে না। সিঙ্গাপুরের নাগরিকরা বেশিরভাগ কথার শেষে ‘লা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এই যেমন ‘ওকে’কে বলেন ‘ওকে-লা’, ‘থ্যাঙ্কউ’ বলার সময় বলেন ‘থ্যাঙ্কউ-লা’ ইত্যাদি।
সিঙ্গাপুরের নাগরিকরা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততম হাঁটা মানুষ (fastest walking speed)। ১০.৫৫ সেকেন্ডে সিঙ্গাপুরিয়ানরা হাঁটে ১৮ মিটার, মানে ঘণ্টায় ৬.১৫ কিলোমিটার। সেখানে ভারতীয়দের হাঁটার গতি ঘণ্টায় গড়ে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার।
এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে সবকিছুতে এতো এতো জরিমানা থাকায় #ফাইন_সিটি বা “জরিমানার শহর” হিসেবে এটি পরিচিতি পেয়েছে। ইন্টারনেট থেকে গান বা সিনেমা ডাউনলোড করাও এখানে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। ২০০৬ সালে এই অপরাধে সিঙ্গাপুরের ২নাগরিককে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। আরো একটি অদ্ভুত নিয়মের দেখা মেলে এখানে। ভুল করেও যদি কাউকে অনুমতি ছাড়া জড়িয়ে ধরেন, করে ফেলবেন দন্ডনীয় অপরাধ।! ১৯৯২ সাল থেকে পথচারীদের অসুবিধা সৃষ্টি হওয়ার কারণে চুইংগামকে নিষিদ্ধ করা হয়।
সিঙ্গাপুরিদের কথিত একটি লোককাহিনী আছে। একবার সিঙ্গাপুরের মানুষেরা ভয়ংকর বিপদে পড়ে। তখন সাগর থেকে সিংহ-মৎস্য আকৃতওর এক জন্তু এসে বাঁচায় অধিবাসীদের। সিংহপুর বা সিঙ্গাপুর নামকরণের ক্ষেত্রেও এই লোককাহিনীর প্রভাব আছে বলে অনেকে মনে করেন। মারলিন বা সিংহ-মৎস্য তাই সিঙ্গাপুরীদের গর্বের প্রতীক।এই লোককাহিনী ধরে রাখতে তাই তারা গড়ে তুলেছে মারলাওন পার্ক। পৃথিবীর প্রথম ও একমাত্র নাইট সাফারি পার্ক ও সিঙ্গাপুরে অবস্থিত। এডভেঞ্চারপ্রিয়দের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা এটি। গভীর রাতে জঙ্গলের বন্য পশুপাখির মাঝ দিয়ে ট্রামে চড়ার রাস্তা আছে এই পার্কে।
সৌন্দর্যের এই শহরে ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে বিশ্বেের সবথেকে ভালো এয়ারপোর্টটি (চাঙ্গা) অবস্থিত। যা, আপনাকে আকাশপথের ভ্রমণ সুন্দরভাবে আপ্যায়ন করবে।বিশ্বের মিলিয়নারদের মধ্যে এইদেশের অবস্থান শীর্ষে। কোটিপতি বাসিন্দাদের শতকরা হারে দেশের প্রতি ৬জন গৃহস্হালির মধ্যে একজন মিলিয়ন ডলারের মালিক।
আমরা যখন আমাদের দেশকে খুব ছোট মনে করি, সেখানে সিঙ্গাপুরের আয়তন মাত্র ৬৯৯ বর্গকিলোমিটার! অথচ, অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ এই দেশটি আমাদের স্বাধীনতার মাত্র ৬বছর আগে স্বাধীন হয়েছিল। আজ তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য মাউন্ট এলিজাবেথ পাহাড়ের সমান…
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া, গুগল, বিবিসি
Very Interesting and informative article