ইসলাম

সূরা ফালাক বাংলা উচ্চারণ, অর্থ, শানে নুযুল ও ফজিলত

সূরা আল-ফালাক মাক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। সূরা আল-ফালাক কোরআন মাজিদের ১১৩ নাম্বার সূরা। এই সূরার মোট আয়াত সংখ্যা ৫ টি।

সূরা ফালাক এর আরবী উচ্চারণ

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ ٱلْفَلَقِ
مِن شَرِّ مَا خَلَقَ
وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ
وَمِن شَرِّ ٱلنَّفَّٰثَٰتِ فِى ٱلْعُقَدِ
وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ

সূরা ফালাক এর বাংলা উচ্চারণ

১) কুল আ‘ঊযুবিরাব্বিল ফালাক
২) মিন শাররি মা-খালাক।
৩) ওয়া মিন শাররি গা-ছিকিন ইযা-ওয়াকাব।
৪) ওয়া মিন শাররিন নাফফা-ছা-তি ফিল ‘উকাদ।
৫) ওয়া মিন শাররি হা-ছিদিন ইযা-হাছাদ।

সূরা ফালাক এর বাংলা অর্থ

১) বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার,
২) তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে,
৩) অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়,
৪) গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিনীদের অনিষ্ট থেকে
৫) এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।

সূরা ফালাক এর শানে নুযুল

সূরা ফালাক ও পরবর্তী সূরা নাস একই সাথে একই ঘটনায় অবতীর্ণ হয়েছে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রাহেমাহুল্লাহ উভয় সূরার তাফসীর একত্রে লিখেছেন। তাতে বলেছেন যে, এ সূরাদ্বয়ের উপকারিতা ও কল্যাণ অপরিসীম এবং মানুষের জন্যে এ দু’টি সূরার প্রয়োজন অত্যধিক। বদনজর এবং সমস্ত দৈহিক ও আত্মিক অনিষ্ট দূর করায় এ সূরাদ্বয়ের কার্যকারিতা অনেক। বলতে গেলে মানুষের জন্যে শ্বাসপ্রশ্বাস, পানাহার ও পোষাক-পরিচ্ছদ যতটুকু প্রয়োজনীয়, এ সূরাদ্বয় তার চেয়ে বেশী প্রয়োজনীয়।

সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস একই প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে বলে মুফাসসিরগণ মত ব্যক্ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ স. জাদুর কারণে অসুস্থ হওয়ার ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সূরাদ্বয় মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। কেননা রাসূলুল্লাহ স.-কে জাদু করার ঘটনা মদীনার ইহুদীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল । আবার অনেক মুফাসসিরগণ সূরাটা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন। বস্তুত দুটি মতই বিশুদ্ধ। কেননা সূরাদ্বয়ের ভাব বিশ্লেষণ ও বক্তব্যের বিষয় হতে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, সূরা দুটি প্রথমে মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।

মক্কায় সূরা দুটি নাযিলের প্রেক্ষাপট ছিল এমন যে, রাসূল স.-এর নবুওয়াতের আলোক মশাল উজ্জ্বলিত হলে মক্কার মুশরিকরা তাঁর বিরোধিতা শুরু করে। নানাভাবে তাঁর ক্ষতি করার পাঁয়তারা করে। এমন করুণ মুহূর্তে মহান আল্লাহ তাঁর নবী স.-কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এবং তাঁরই নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করার জন্য সূরা দুটি অবতীর্ণ করেন। এ সূরা দুটির ভাব-বিষয় এক হওয়ার কারণে ‘সূরাতাইন মু’আওয়াযাতাইন’ (দুটি আশ্রয় প্রার্থনার সূরা) বলা হয় ।

সপ্তম হিজরী মুহাররম মাস। খাইবার হতে ইহুদীদের একটি প্রতিনিধিদল মদীনায় উপস্থিত হলো এবং লবীদ ইবনে আ’সম নামের একজন প্রখ্যাত জাদুকরের সাক্ষাৎ করল। তারা তাকে বলল, “মুহাম্মদ আমাদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তা তুমি ভালো করেই জানো; আমরা তাঁর ওপর জাদু করার বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু সফলতা লাভ করতে পারিনি। এই কারণে আমরা তোমার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমরা তোমাকে তিনটি ‘আশরাফি’ (স্বর্ণমুদ্রা) দিচ্ছি; তুমি এটা গ্রহণ করো ও মুহাম্মদের ওপর খুব শক্ত ও তীব্র ক্রিয়াসম্পন্ন জাদুর আঘাত হানো।”

এই সময় রাসূলুল্লাহ স.-এর কাছে একটা ইহুদী ছেলে খাদেম ছিল । এই ছেলেটির সঙ্গে যোগসাজশ করে ওই জাদুকর রাসূল স.-এর চিরুনির একটি টুকরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো। এতে রাসূল স.-এর চুল ছিল। এই চুল ও চিরুনির দাঁতের ওপর জাদু করা হয়। এই জাদু একটা পুরুষ খেজুরগাছের ছড়ার আবরণে রেখে লবীদ বনু যাইকের যারওয়ান বা যী-আরওয়ান নামে এক কূপের তলায় পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল।

জাদুর ক্রিয়ায় রাসূলুল্লাহ স. ক্রমে দুর্বল হয়ে আসছিলেন, কিন্তু নবী হিসেবে তাঁর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল, তা যথাযথ পালন করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারেনি । বস্তুত রাসূল স.-এর ওপর জাদুর ক্রিয়া শুধু তাঁর দেহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তাঁর নবুয়াতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে জাদুর ক্রিয়া সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত ছিল।

শেষের দিকে তিনি একদিন হযরত আয়েশা রা.-এর গৃহে থাকাবস্থায় আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন, মুহূর্তে তিনি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। এই ঘুমের মধ্যে রাসূলে আরাবী দুজন ফেরেশতার মাধ্যমে স্বপ্নযোগে অবহিত হতে পারেন যে, তাঁকে জাদু করা হয়েছে। কীভাবে জাদু করা হলো? কী পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো? এ জাদু থেকে উত্তরণের উপায় কী-সব কিছুই তিনি অবগত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল স. আলী রা. আ’ম্মার ইবন ইয়াসার রা. ও যুবাইর রা.-কে বনু যারওয়ান বা যী-যারওয়ান কূপের কাছে প্রেরণ করেন।

পরে আরো কতিপয় সাহাবাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ স. নিজেও সেখানে উপস্থিত হন। ওই কূপ থেকে পানি তোলা হলো। তখন দেখা গেল যে, খেজুরগাছের ছড়ার সঙ্গে পেঁচানো একগাছি সুতার এগারোটি গিঁট লাগানো রয়েছে। তাঁর সঙ্গে একটি গমের পুঁটলিও ছিল, তাতে কয়েকটি সুঁই বসানো রয়েছে। জিবরাঈল আ. এসে বললেন, আপনি ‘মু’আওয়াযাতাইন’ তথা সূরা ফালাক্ব ও নাস পাঠ করুন। এভাবে রাসূল স. সূরা দুটি পাঠ করার মাধ্যমে জাদুর প্রভাব থেকে আরোগ্য লাভ করেন।

সূরা ফালাক্ব ও নাসের শানে নুযূল সংক্ষিপ্ত ও বিশদ বহু বর্ণনা রয়েছে। অপর এক বর্ণনায় উল্লেখ আছে, একবার রাসূলুল্লাহ স. অসুস্থ হয়ে পড়েন। শারীরিকভাবে প্রচণ্ড অস্থিরতা অনুভব করেন। এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, দুজন ফেরেশতা তাঁর কাছে আগমন করলেন। একজন মাথার কাছে এসে বসলেন আর অন্যজন পায়ের কাছে। তারা উভয়ে পরস্পর কথপোকথন করতে লাগলেন। তারা নিজেদের মধ্যে এভাবে বাক্য বিনিময় করছিলেন। ‘তাঁর কী হয়েছে? তিনি অসুস্থ। কী অসুখ? তাঁকে জাদু করা হয়েছে। কে জাদু করেছে? এক ইহুদী ব্যক্তি, যার নাম লাবীদ ইবনে আ’সাম। কীভাবে জাদু করেছে? চামড়ার ফিতায় জাদুমন্ত্র করে পাথর চাপা দিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে অমুক কূপে। যাও, সেটিকে বের করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দাও।’

রাসূলুল্লাহ স. এতটুকু স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙে গেল। সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ স. কতিপয় সাহাবাকে নিয়ে স্বপ্নে উল্লিখিত কূপে গেলেন। সেখানে পাথর চাপা দিয়ে রাখা জাদুমন্ত্রের ফিতাটি উদ্ধার করে আনলেন। কিতাটিতে একটি সুতা পেঁচানো রয়েছে এবং তাতে এগারোটি গ্রন্থি দেখা গেল। কিন্তু এ গ্রন্থিগুলো না খোলা গেলে নবীজি স.-এর আরোগ্য লাভ সম্ভব হবে না। এমন করুণ পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহ তা’আলা স্বীয় হাবীবের নিকট ওহী প্রেরণ করলেন। এ প্রেক্ষাপটে সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস নাযিল হলো।

এ সূরাদ্বয়ের আয়াত সংখ্যা হলো এগারোটি। প্রিয় নবী এ সূরার একটি করে আয়াত পাঠ করতে লাগলেন আর সঙ্গে সঙ্গে একটি করে গিঁট বা গ্রন্থি খুলে যেতে লাগল । যখন তিনি সূরা দুটি পড়ে শেষ করলেন ততক্ষণে সবগুলো গিট খুলে গেল। এর ফলশ্রুতিতে নবীজি আলাইহিস সালাম সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন এ সূরা দুটির মহত্ত্বের কারণে উলামাগণ বলেছেন, কেউ যদি সব সময় এ সূরা দুটি পাঠ করে তাহলে কোনো জাদু-মন্ত্র তাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে না।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ স. রাত্রিকালে যখন বিছানায় যেতেন তখন তিনি সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে হাতের উভয় তালুতে দিয়ে সারা দেহের যতটুকু অংশ হাতের নাগাল পাওয়া যায় ততটুকু পর্যন্ত হাতের ছোঁয়া দিতেন। প্রথমে মাথায়, তারপর মুখে এবং এরপর দেহের সামনের অংশে তিনবার এভাবে হাত ফিরাতেন। (সহীহ বুখারী-৫০১৭)

সূরা আল-ফালাক এর ফজিলত

আয়েশা (রাঃ) বলেন, যখন মহানবী (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়তেন তখন সূরা ফালাক ও সূরা আন-নাস পড়ে ফুঁক দিয়ে নিজের দেহে হাত বুলিয়ে নিতেন। কিন্তু যখন ব্যথা-যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে যেত তখন বরকতের আশায় আমি তাঁর দেহে হাত বুলিয়ে দিতাম। মুসলিম বর্ণণায় রয়েছে, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে মহানবী (সাঃ) তাকে সূরা ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। সহীহ বুখারী হাদিস ৫০৯২, সহীহ মুসলিম হাদিস ২১৯২

রাসুলূল্লাহ (সাঃ) বলেন, এ দুইটি সূরা তোমরা পড়তে থাক। কেননা, এ দুইটি সূরার মতো অন্য কোন সূরা তোমরা কোনদিন পাবে না। মুসলিম ৮১৪

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জাবের বিন আব্দুল্লাহকে বলেন, اِقْرَأْ بِهِمَا وَلَنْ تَقْرَأَ بِمِثْلِهِمَا ‘এ দু’টি সূরা পাঠ কর। কেননা এ দু’টির তুলনায় তুমি কিছুই পাঠ করতে পার না।

আরো পড়ুনঃ

5/5 - (13 votes)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button