Uncategorized

আঁধারে ফোটা নার্সিসাস

5/5 - (14 votes)

পাতালপুর! সাধারণত যেখানে যাওয়ার পূর্বশর্তই হচ্ছে মৃত্যু। পাঁচটি নদী দিয়ে ঘেরা সেই পাতালপুর, যা পার হয়ে সেখানে পৌঁছানোও সহজ কথা নয়। চোখের উপর করে নিয়ে যেতে হবে নগদ পয়সা, নিতে হবে ক্যারন নামক মাঝির সাহায্য। নাহলে ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরতে হবে নদীর তীরে তীরে অন্তত শতবছর, এরপর মিলবে অনুমতি। ক্যারণ তার নৌকায় করে পৌছে দিবে পাতালপুরের অধিশ্বর, দেবতা হেডিসের রাজ্যের ফটক অবধি।

যদিও ঝামেলা এখানেই শেষ নয়। কড়া পাহাড়ায় সেখানে রয়েছে দেবতা হেডিসের পোষ্য তিনমাথাওয়ালা হাউন্ড- সারবেরাস। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সেই রাজ্যে প্রবেশ করা তো সম্ভব, কিন্তু সেখান থেকে বের হওয়া অসম্ভবের নামান্তর। আজকে আমাদের গল্প সেই অন্ধকার পাতালের নিরুত্তাপ দেবতা হেডিস কিভাবে প্রেমে পড়েছিলেন পার্সিফোনের তাই নিয়ে।

আদি দেবতা ক্রোনাস এবং দেবী রিয়ার প্রথম পুত্র এবং চতুর্থতম সন্তান ছিলেন হেডিস। অলিম্পিয়ানরা দীর্ঘ ১১ বছর  টাইটানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হবার পর তিন ভাই- জিউস, পোসিডন এবং হেডিস তিনজনের মধ্যে যথাক্রমে আকাশ-বজ্র, সমুদ্র এবং পাতালপুরী ভাগ করে নিলেন। পাতালপুরী লাভের মধ্যে দিয়েই হেডিস হলেন সকল দেবতাদের চেয়ে বিত্তশালী, কারণ ভূমিতলেই রয়েছে রাশি রাশি খনিজ ও সম্পদ। কিন্তু সাথে সাথে লাভ হলো প্রগাঢ় একাতীত্ব। অবশ্য নিজ রাজ্যে, নিজ কাজে তিনি এতটাই নিবিষ্ট থাকতেন যে- অলিম্পাস পর্বতে দেবতাদের সভাকক্ষেও দৈবাৎ অতি দরকারে দেখা যেত তাকে।

গ্রীক শব্দ হেডিস অর্থ হচ্ছে যাকে দেখা যায় না, অদৃশ্য! পাতালপুরের দেবতাও ঠিক ছিলেন তেমনি। তার তেজস্বী কৃষ্ণকায় বলিষ্ঠ দেহে একাকার হয়ে থাকতো পাতালের নিকষ অন্ধকার, সকলের চক্ষুর আড়ালে থাকাটা তার গাম্ভীর্যে যোগ করেছিলো আলাদা এক শীতল কঠিনতা। সকল উষ্ণতা-আনন্দ থেকে ছিলেন তিনি যোজন যোজন দূরে। আবলুস রঙা সিংহাসনের পাশে তার সঙ্গী হয়ে থাকতো শুধু তার পোষ্য হাউন্ড- সারবেরাস। নির্জনতা হেডিসকে সকল সৃষ্টির কাছে বানিয়ে ফেলেছিলো অপরিজ্ঞাত এবং ভয়ংকর। ঠিক এতটাই ভয়ংকর যে কেউ তার নাম নিতেও ভয় পেত, পূজোও হতো না তার। এইসবে খুব একটা যায় আসতো যে হেডিসের তেমনটাও নয়, মাথা গুঁজে পড়ে থাকতেন নিজ কাজে।

hedis in love
hedis in love

গ্রীক প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির কাছে হেডিসের এই একাকীত্বের বিষয়টা ভালো লাগলো না। তিনি তার পুত্র এরসকে নির্দেশ দিলেন এই অসাড় মনে প্রেমের হুল ফোটাতে। একদিন জিউসের সভা ত্যাগ করে হেডিসের চলে যাওয়ার পথে এরস তারদিকে বাণ ছুড়লেন, লক্ষ্যভেদ করলো তীরটি। কিন্তু হেডিস টেরটিও পেলেন না।

পার্সিফোন হলেন ধরণীর দেবী দিমিতির আর দেবতা জিউসের কন্যা। দেবী দিমিতির তার এই একমাত্র কন্যাকে সর্বাধিক ভালোবাসতেন আর আগলে রাখতেন চোখের মণি করে, কখনও কাছ ছাড়া হতে দিতেন না। সেই ছোট্টবেলা থেকে সারা বিশ্বময় ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন পার্সিফোন দিমিতিরের সাথে। বেড়ে ওঠেন মায়ের ছায়াতলে আর প্রকৃতির সমাবেশে। এইজন্য পরিপূর্ণ বয়সে এসেও পার্সিফোন ছিলেন বালিকার মতন সরল ও নির্মল। যখন সে ফসলের মাঠে, বনে বনে এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়াতেন, তখন তার পবিত্রতা আর উষ্ণতায় চারপাশও আনন্দে ঝলমল করতে থাকতো। প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা পার্সিফোন থাকতেন প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে, খেলে বেড়াতেন গাছপালা, জল ও নিম্ফদের মাঝে। কিন্তু সবচেয়ে পছন্দ ছিলো শ্বেত-শুভ্র নার্সিসাস ফুল।

এদিকে হেডিস পার্সিফোনের প্রেমে-বিরহে পাগলপ্রায়। সকল কাজকর্ম চুলোয় গেলো। একসময়ে পাতাল ছেড়ে বেরোতে না চাওয়া দেবতা এখন সুযোগ পেলেই ধরায় বের হয়ে পার্সিফোনকে অপলক নরম চোখে দেখতে থাকেন, তার মন স্নিগ্ধ হয়ে আসে। নারী বিবর্জিত জীবন কাটানো হেডিস পার্সিফোনকে ছুঁয়ে আসা এক পশলা বাতাসের স্পর্শের জন্য পর্যন্ত ব্যাকুল উঠতে লাগলেন দিনদিন।

হেডিস জানতেন তার চাওয়াতে কখনওই দিমিতির সম্মতি দেবেন না, নিয়ে যেতে দেবেন না তার প্রাণপ্রিয় মেয়েকে সেই অন্ধকার পাতাল জগতে। তাই হেডিস পার্সিফোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব এবং পরামর্শের জন্য ধর্না দিলেন পার্সিফোনের পিতা দেবতা জিউসের কাছে। কঠোর সেই পাতালপুরীর দেবতা যেন হয়ে গেলেন আজলা ভরা জলের মতন তরল, কাতর অনুনয় করে পার্সিফোনকে নিজের করে নিতে চাইলেন। দেবরাজ জিউস সানন্দে রাজি হলেন এই প্রস্তাবে। তিনি বুদ্ধি দিলেন নার্সিসাস ফুলের প্রলোভন দেখিয়ে পার্সিফোনকে তুলে নিয়ে পাতালে লুকিয়ে ফেলতে।

একদিন সদ্য আলো ফোটা ভোরে পার্সিফোন বনের ঘাসে বেড়াতে বেড়াতে নদীর ধারে চলে এলেন, দেখলেন সারি সারি নার্সিসাস ফুল ফুটে ভরে আছে চারপাশ। খোঁপার মালা গাঁথবার জন্য তিনি কোচড় ভর্তি করে ফুল তুলতে লাগলেন। আচমকা প্রচন্ডভাবে মাটি কেঁপে উঠলো, ফাটল ধরে দুই ভাগ হয়ে গেলো। তার ভেতর থেকে মিশমিশে কালো ঘোড়ায় টানা সোনার রথে করে বেড়িয়ে এলো এক অশ্বারোহী।

হেডিস! পার্সিফোনকে হেডিস তুলে নিলেন তার রথে। আকস্মিক ঘটনা আর আতঙ্কে পার্সিফোন চিৎকার করে উঠবার আগেই হেডিস তাকে নিয়ে পাতালে ডুবে গেলেন। ওদিকে হঠাৎ দিমিতিরের মনে হলো বহুক্ষণ ধরে তিনি পার্সিফোনকে দেখতে পাচ্ছেন না। পাগলের মতন খুঁজতে লাগলেন মর্ত্যলোকের এমাথা-ওমাথা, পেলেন না। অবশেষে জলপরী সায়েনের দেখা পেলেন। সায়েন কাঁদতে কাঁদতে জানালো সে শুধু তার প্রিয় সখীর আর্তনাদ শুনেছে, কি পরিণতি হয়েছে তা সে বলতে পারবে না। সখীর বিরহে সায়েনের অশ্রুজলেই সেখানে সৃষ্টি হলো সায়েন নদীর।

পাতালে গিয়ে পার্সিফোন অনবরত কেঁদেই যাচ্ছিলেন, মায়ের আঁচলে বড় হওয়া পার্সিফোন কিছুতেই মায়ের বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারছিলেন না। হেডিস ভাবতে লাগলেন কিভাবে পার্সিফোনের মনের দোরগোড়ায় পৌঁছুবেন, কিভাবে তার রূঢ় অবয়বের পেছনের বিগলিত মনটা উন্মোচন করবেন পার্সিফোনের সামনে। হেডিস নানাভাবে তার মন ভালো করার চেষ্টা করতে লাগলেন, সিংহাসনে তার পাশে জায়গা দিলেন, দিলেন পাতাল রাজ্য শাসনের সমঅধিকার। নিজ ভালোবাসা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন উপায়ে দেখাতে লাগলেন।

পুরোপুরি মন ভালো না হলেও, পার্সিফোন অনেকটা প্রবোধ মানলেন। কারণ এর আগে এমন আচরণ তার সাথে কেউ করেনি, সবসময় শিশুতুল্য আদর-ব্যবহারের মাঝে বড় হয়েছে সে। কেউ তার পরামর্শ নিতে চায়নি, প্রেম ব্যাপারটা তাকে এর আগে কখনও স্পর্শ করেনি। অদ্ভুত এক শিহরণে রোমাঞ্চিত হলেন পার্সিফোন, দিন কাটাতে লাগলেন আলাদা এক মর্যাদা আর ভালোবাসায়। এমনকি পার্সিফোনের নির্দেশে হেডিস পাতালে মৃত আত্মাদের জন্য একটি স্বর্গস্বরূপ বাগান তৈরী করে দিলেন, নাম দেয়া হলো তার এলিসিয়াম। হেডিসের আত্মোৎসর্গ আর নিষ্ঠা ধীরে ধীরে পার্সিফোনের মনকে পুরোপুরি বিমোহিত করে ফেললো।

অন্যদিকে দিমিতির তখন শোকে পাগলপ্রায়। তার অবহেলায় পৃথিবীতে ক্ষরা শুরু হলো, মাটি শুকিয়ে পাথরের মতন হয়ে গেলো। মাটি এতটাই রুক্ষ-শুষ্ক হলো যে ফসল ফলা তো দূরে থাক, ঘাসও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। সর্বত্র বিষাদ ঘনিয়ে এলো! জিউস চিন্তিত হয়ে উঠলেন, ভাবলেন এভাবে চলতে থাকলে তো মানবসভ্যতা ধংস হয়ে যাবে, কেউ থাকবে না তাকে পূজো করার জন্য।

ঠিক তখনই দিমিতিরের কাছে আবির্ভূত হলেন জাদু-মায়াবিদ্যার মহাজাগতিক দেবী হেকাতে। হেকাতে বললেন- জিউস অবশ্যই এই ব্যাপারে জানেন, এবং পরামর্শ দিলেন জিউসকে বিস্তারিত গিয়ে জিজ্ঞেস করতে। তৎক্ষনাৎ দিমিতির গেলেন জিউসের দরবারে, জানালেন তার অভিযোগ। সাথে সাথে এটাও জানান দিলেন যে- তার কন্যাকে ফেরত না দেয়া হলে তিনি পৃথিবীর বুকে আর কোন ফসল ফলাবেন নাহ, সব নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। জিউস পড়লেন মহা বিপাকে। তিনি হার্মিসকে আদেশ দিলেন অতিদ্রুত পার্সিফোনকে নিয়ে আসতে। হার্মিস বাতাসের বেগে ছুটে চললেন পাতালপুরীর দিকে।

হার্মিস যখন পার্সিফোনকে আনতে গেলেন তখন হেডিস তাকে কোন বাধাই দিলেন না, বিদায় বেলাতে উপহার হিসেবে পার্সিফোনের হাতে শুধু একটি ডালিম তুলে দিলেন। পাতালে থাকা অবস্থায় এতদিন পার্সিফোন কিচ্ছু মুখে তুলেননি, কারণ রীতি অনুযায়ী সে যদি সেখানের কিছু খেত তাহলে পাতালের চিরস্থায়ী অধিবাসী হয়ে যেত। কিন্তু হেডিসকে রেখে ফেরার সময় সবকিছু দুমড়েমুচড়ে মন খারাপ হতে শুরু করলো তার, পার্সিফোন এই অনুভূতির সাথে পরিচিত ছিলেন না। উপহার গ্রহন করে অদ্ভুত এক বিষাদ নিয়ে বিদায় নিলেন পার্সিফোন।

এদিকে পার্সিফোনকে দেখতে পেয়ে তার মা দিমিতির আনন্দে আত্মহারা, আবার চতুর্দিক রঙে রঙে ফুলে-ফসলে ভরে উঠতে লাগলো। পার্সিফোনও ভীষণ খুশী, কিন্তু অমীমাংসিত এক মানসিক টানাপোড়েনে পড়ে গেলো সে। তার এই খুশীর পাশাপাশি বয়ে চলেছে এক নিগূঢ় যন্ত্রণা। সবকিছু ছাপিয়ে হেডিসের বিরহই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। অবশেষে পার্সিফোন সিদ্ধান্ত নি্লেন ডালিমটি খাবার, কয়েকটি দানা মুখে পুরবার সাথে সাথেই দেবতা হেডিস সামনে প্রকট হলেন।

দিমিতির ছুটে গেলেন তার কন্যাকে আগলে ধরতে, আকুল আবেদন জানাতে শুরু করলেন যাতে সে তাকে ছেড়ে আবার না যায়। ঠিক তখুনি শীতল অথচ ইস্পাত কঠিন কন্ঠে হেডিস জানা্ন দিলেন- পার্সিফোন এই ফলটি(ডালিম) খেয়েছে, তাই সে তার সাথে নিয়ম অনুযায়ী ফিরে যেতে বাধ্য। দিমিতির ক্রোধে উন্মত হবার উপক্রম করতেই জিউস তাকে থামিয়ে দিলেন। পার্সিফোনকে জিজ্ঞেস করলেন সে কয়টি বীজ খেয়েছে। পার্সিফোন জানালেন- ছয়টি।

ব্যস, জিউস রায় দিলেন-এখন থেকে বছরের ছয় মাস পার্সিফোন পাতালপুরীতে গিয়ে হে্ডিসের সাথে সংসার করবে, কিন্তু বাকি ছয়মাস সে থাকবে তার মায়ের কাছে। হেডিস এবং দিমিতির কেউই এই রায়ে পুরোপুরি সন্তষ্ট হলেন না, কিন্তু মেনে নিলেন।

এরপর থেকে পার্সিফোন ছয়মাস পাতালপুরে গিয়ে দেবতা হেডিসের সাথে বাস করেন এবং পাতালরাজ্য শাসন করেন। তখন দিমিতির বিষাদ্গ্রস্থ হন, ধরনী অনুর্বরা হয়ে যায়। আবাদ কমে যায়, ফুল-পাতা শুকিয়ে আসে। এরপরের ছয়মাস আবার সে মায়ের কোলে ফিরলে পৃথিবী খুশীতে ঝলমলিয়ে ওঠে। তখন বসন্ত আসে!

গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখিঃ মৃত্য থেকে যার জন্ম! এই অসাধারন গল্পটিও আমাদের ওয়েবসাইট থেকে পড়ে নিবেন।

zahid

A professional SEO Expert & Digital Marketing Consultant. Enhancing online visibility of business is my job. Keeping update myself with new search algorithm update and stay top on search results is my passion.

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button