একুশে ফেব্রুয়ারি
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জীবনের শোক, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীরা বলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দাবি উঠে, বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি 1952 বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরো অনেক ছাত্র জনতার তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়। ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গ করে পৃথিবীর বুকে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সেই রক্ত রঞ্জিত বাংলা ভাষা এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬% লোকের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। পাকিস্তানের মাত্র ৩.২৭% লোকের মুখের ভাষা ছিল উর্দু।১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ – Tamuddun Majlish নামে একটি সাংস্কৃতিক গড়ে তোলেন। ১৫ই সেপ্টেম্বর তমুদ্দুন মজলিশ ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু প্রকাশ করে। পুস্তিকাটির লেখক ছিলেন তিনজন।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ অধিবেশনে পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষারূপে সরকারি স্বীকৃতির দাবি জানান। কিন্তু গণপরিষদ এ দাবি প্রত্যাখ্যান করলে পূর্ব বাংলার ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহলে অসন্তোষ দেখা দেয়।১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ কামরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সরকারের ষড়যন্ত্রের জন্য সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ঐদিন বহু ছাত্র আহত শেখ মুজিব সহ অনেকে গ্রেফতার হন। এজন্য ১৯৪৮-৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় কালে প্রতিবছর ১১ই মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে পালন হতো।
১৯৪৮ সালে ২১শে মার্চে রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক জনসভার ঘোষণা দেন। উর্দু এবং উর্দুই হবে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্দা একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা ‘ না না’ বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।১৯৪৯ সালে পূর্ববাংলা সরকার ভাষা সংস্কারের নামে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করে যার সভাপতি ছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ।১৯৫০ সালে লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।
১৯৫২সালের ২৬শে জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় 1 জনসভায় ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুব আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। “All parties state language movement committee”
১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) রোজ বৃহস্পতিবার সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে নুরুল আমিন সরকার সারাদেশে ১৪৪ধারা জারি করে এবং সভা-স্মাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে সমবেত হয়। পুলিশ উপস্থিত ছাত্রজনতাকে সূত্র বঙ্গ করতে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করলে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ বাধে। রফিকউদ্দিন ঘটনাস্থলে শহীদ হন, আন্দোলনের প্রথম শহীদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আব্দুল বরকত, আব্দুস সালাম আব্দুল জব্বার প্রমুখ। ৯ বছরের শিশু ওহিউল্লাহও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলি বর্ষনের প্রতিবাদে বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। এ শোভাযাত্রার উপরও পুলিশ গুলি করে। ফলে শফিউর রহমান মৃত্যুবরণ করেন।১৯৫৩ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে দেশব্যাপী শহিদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৫৪ সালের ৯মে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদনের মাধ্যমে অব্যাহত আন্দোলন তার লক্ষ অর্জন করে। জাতীয় পরিষদে বিষয়টি বিতর্কের এক পর্যায়ে ফরিদপুরের সদস্য আদেলউদ্দিন আহমেদের দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বাংলাকে জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহারের জন্য আইন পাস করা হয়।
কানাডা প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম এর উদ্যোগে UNESCO’র ৩০তম সাধারণ সভার শেষ দিন অর্থাৎ ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে স্বীকৃতির প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ২০০০ সালে প্রথম বারের মত বিশ্বব্যাপী ১৮৮টি দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে UNESCO’র পর জাতিসংঘও ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ভারত ও সিয়েবালিয়নের সরকারি ভাষা বাংলা। সিয়েবালিয়ন বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিয়েছে।
বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখা এবং পৃথিবীর সকল ভাষার গবেষণা উন্নয়ন সংরক্ষণ ও সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (IMLI) যা ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত।
১৫ ই জানুয়ারি ২০০১ অনলাইনে যাত্রা শুরু করা বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া ২০০৮ সালে বাংলা ভাষার সংস্কার চালু করে।
৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে প্রতিষ্টিত হওয়া ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ২০০৯ সালে বাংলা ভাষা উন্মুক্ত করে।
২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় ভাষণ দান করেন শেখ মুজিবুর রহমান।
অবশ্য এ আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল আরো আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। প্রকৃত বিচারে ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালির অত্বপরিচয়ের সঙ্কট থেকে উত্তরণের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বাঙ্গালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে, অন্যদিকে সমগ্র বাঙ্গালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়। এটি একইসঙ্গে ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। বলা যায়, ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙ্গালির স্বাধিকার অর্জনের বীজমন্ত্র।