গল্প

পুত্রবধু

আজকে আমি যার কথা শেয়ার করতে যাচ্ছি সে আমার এক ছোট বেলার ফ্রেন্ড এর গল্প।আমি তার গল্পটা শেয়ার করছি ঠিক আমার জবানীতে।

আমি তখন একটা অসুস্থ পরিবারের পুত্রবধু।

আমি জানি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু পরিবারে ছেলের বউদের মূল্য ঠিক বাড়ির আসবাবপত্র গুলোর মতো। প্রয়োজনে ব্যবহার করলাম, আর নাহয় যেটা যেই জায়গায় আছে সেভাবেই পড়ে থাকুক। তারা তো ঘরের সৌন্দর্য বর্ধন করতে ব্যবহৃত হয় শুধু।

আমিও এমন ই এক আসবাবপত্র।

আমার বিয়ে হয় অনেক শিক্ষিত এবং যথেষ্ট ধনী পরিবারে। ছেলে জব করে।ভালো স্যালারি। মা ভেবেছিলো আমি সুখে থাকবো কারন ছেলে অনেক ভালো।

পুত্রবধু

আমার তখন ৭ম সেমিষ্টার চলে। ভীষণ কঠিন পড়া আর আমার ইচ্ছে ছিলোনা বিয়ে করার। তারপর ও বাবা মা সবার কথা চিন্তা করে ঠিক বাঙালী মেয়েদের মতো বিয়ের পীড়িতে বসলাম। বিয়ের ঠিক আগে বলা হয়েছিলো ৩ মাস পর তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু হঠাত ই বলা হলো আমাকে বিয়ের দিন ই শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। আচ্ছা ভালো কথা, তাদের কথা মতোই সব মেনে নেয়া হলো।

শ্বশুরবাড়ির ফার্স্ট দিন অনেক ভালো ছিলো সবার সাথে। পরদিন থেকেই আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হলো আমি এখন আর মেয়ে নই আমি একটা ঘরের বউ। অনেক রেস্পনসিবিলিটি আমার। আমি হাসি মুখে তাও মেনে নিলাম। মেনে যে নিতেই হতো। কিন্তু কেউ কাছ থেকে এগিয়ে এসে বুঝিয়ে দিয়ে যায় নি যে কি দায়িত্ব আছে আমার!

এখন একটু নিজের কথায় আসি।

পুত্রবধু

আমি একটা সুন্দর এবং শৃঙ্খল পরিবারের খুবই অবিডিয়ান্ট আর সবচেয়ে ছোট মেয়ে। তো বুজতেই পারছেন কতটা লাডলি আমি ঘরের। ঠিক সত্যিই তাই। আমার মার ভাষায় আমি তার সখের বাবু। প্রতিদিন সকালে ফযর নামাজে মা আমাকে কপালে একটা চুমু দিয়ে ঘুম থেকে উঠাতো।

আমার আরো একটা ভাই আর বোন আছে। যারা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। আমার মনে হয় জীবনের প্রথম অধ্যায় টাতেই তাদের কাছ থেকে সব ভালোবাসা পেয়ে গিয়েছিলাম বলে পরের টায় ভাটা পড়ে গিয়েছিলো। এখানে বলে রাখা ভালো আমি কিন্তু দারুন মেধাবী, হাসিখুশি আর দেখতেও সুন্দর ছিলাম।

কি মনে হচ্ছে? নিজের কথা একটু বাড়িয়ে বলছি? না না না!! এগুলো আমার কথা না। এগুলো লোকে বলতো। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি খুশিতে গদগদ হতাম না!!!আচ্ছা যাজ্ঞে ওসব কথা। আসল কথায় আসি। যা বলছিলাম।

বিয়ের নতুন শাড়ি, সাজ আর গহনার ঘোর না কাটতেই মাথায় নানা অপবাদ লাগতে আরম্ভ করলো। এমন না যে, আমি খুব সখ করে বিয়ে করেছি, যাস্ট মা বাবা বললো আর তাদের অনেক বুঝানোর পর ও কাজ না হওয়ায় রাজি হয়েছি শুধু। এর মানে অলরেডি আমার কাছে এই বিয়েটা খানিকটা বোঝা, তার মাঝে শ্বশুরবাড়ির নানা অপবাদ। কারন আমি বাসায় সময় দিতে পারতাম না, আমার ভার্সিটি যেতে হতো। নতুন ঘরের নিয়ম কানুন বুজতাম না, কারন আমাকে কেউ বুঝতে সাহায্য ও করে নি। সুতরাং নতুন পরিবেশে নানা কারনে অকারনে আমি ডিপ্রেশন এ পড়ছিলাম।

পুত্রবধু

এখন এতগুলো কষ্টের মাঝে আমার একটা নতুন সুখের নাম ছিলো “আমার উনি”। কি?হাসি পাচ্ছে? এরকম সবাই ই হাসে। আমি যখন বিয়ে করি আমি তখনো লোকটাকে ওভাবে চিনিনা। চিনিনা বলতে এর আগে আমাদের দুবার দেখা হয়েছিলো ঠিকই, সেই দেখা থেকে শুধু বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ওই গল্প অন্যদিন বলবো নাহয়। উনি আমার একমাত্র আর সবচেয়ে ভালো রোল টা প্লে করেছে আমার জীবনে। উনাকে নিয়ে লিখতে গেলে আসলে শেষ হবেনা আর এই লিখা। কিন্তু একটা কথা না বললেই না। শত চেষ্টা করেও উনি আমাকে বাঁচাতে পারেনি হাজারটা কষ্টের হাত থেকে যার শুরু হয়েছিলো সেই দিন টায়।

সেদিন বাসায় ছোট একটা প্রোগ্রাম ছিলো। প্রোগ্রাম এর পরদিন ঘর ভর্তি মানুষ ছিলো। আমার তখন নতুন বিয়ে হয়েছে। আমার মার দেয়া টাকায় আমার রুম এ ফার্নিচার বানানো হচ্ছিলো। আমি তখন নানা নির্দেশনা দিতে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করে উঠতে পারিনি যে চুলায় খিচুড়ি বসানো ছিলো। আমার নাকে হালকা একটু পুড়ে যাওয়ার গন্ধ লাগতেই দৌড় দিয়ে গেলাম দেখতে।

ততক্ষণ এ সেখানে আরো অনেকেই এসেছেন। আমার মা(শ্বাশুড়ি) কিছু বুঝে উঠার আগেই পাতিল টা আমার পায়ে ছুড়ে মারলো। ভাবটা এমন যেনো সবটা দোষ আমার। ভয়ে আর ব্যাথায় পিছনে সরে যাই আমি। কিছু না বলে দৌড় দিয়ে চলে আসি রুম এ। সবার চোখ আড়াল করে বাথরুম এ যেয়ে ভালোভাবে পানি দিয়ে নেই পায়ে।

এত ব্যাথা পাওয়া সত্বেও কষ্ট পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, যে আমি কিনা নারীদের সমান অধিকার আর তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় এর প্রতিবাদ করতাম সেই আমার সাথেই ঘটে যাওয়া অন্যায় এর বেলা আমার মুখ দিয়ে একটা কথা বের হলোনা!! আমি অবাক হলাম আর প্রচন্ড কষ্টে নুয়ে পড়লাম এই ভেবে যে, না জানি এদেশের নারীরা কত কষ্ট ভোগ করছে রাতদিন নিরবে। নিজেকে এতটা ছোট জীবনে ও কখনো ফিল করিনি। ওইদিন থেকে আমি একদম চুপ হয়ে গেছি।

আমি বুজতে পারছিলাম আমার চুপ থাকাটাই আসলে আমার জন্য কাল হয়ে যাচ্ছে। কারন তারা আমার চুপ থাকাটাকেই হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছিলো। যখন যা আসতো মুখ দিয়ে,, বলতো। যতদিন সবকিছু আমার পর্যন্ত ছিলো তা নাহয় মেনে নিতাম। দিন যত যাচ্ছিলো আমার শাশুড়ি আমার মার কাছে বিচার দিতে আরম্ভ করলো। উনাকে নানাভাবে ছোট করতে আরম্ভ করলো যেখানে আমি নিজেও একজন শিক্ষিতা এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলাম।

আমার খুব কষ্ট লাগতো যে মা কে আমি সারাজীবন সম্মান দিয়ে এসেছি এবং উনি আমাকে নিয়ে সবচেয়ে গর্বিত ছিলো ওই মা আজ আমার জন্য কথা শুনতেছে। আমি শুধু আমার দোষ খুজে বেড়াতাম এই ভেবে যে এটা শুধরিয়ে নিলে আমার মা আর কথা শুনবে না। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম তারা চুপ হবার মতো ছিলোনা।

বিচারগুলোর ধরন আর দশটা ফ্যামিলির মতোই ছিলো। আমি যেহেতু বিয়ের আগে আমার ফ্রেন্ড দের সাথে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে ছিলাম, তো স্বভাবতই আমার ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস ছিলো ৯টা। এখানে আসার পর পর ই হয়তো ১সপ্তাহ আমাকে সময় দেয়া হয়েছিলো এই ব্যাপারটায়। যার ৪দিন ই আমার কেটেছে ভার্সিটি তে। তখন উঠতে হতো সকাল ৭ টার আগে। তাই সব মিলিয়ে আমি বুঝেও উঠতে পারিনি যে আমার জলদি ঘুম থেকে না উঠাটা আমার দোষ হচ্ছিলো। আর হয়তো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা দোষ ও।

যাই হোক এত হঠাত বিয়ে হওয়ায় আসলে আমি সব ম্যানেজ করে নিতে পারছিলাম না। সো ফার্স্ট বিচারই ছিলো এই ঘুম নিয়ে। আমার মা শুধু আমাকে বুঝাতেন যে এখন সব চেঞ্জ হয়ে গেছে। আমারো বুঝা উচিৎ। আমি মার কথা মতো বুজতে শুরু করলাম। সবকিছুর স্ট্রেস এ আমি কয়েকদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তখন থেকে বলা শুরু হলো আমার মা চালাকি করে অসুস্থ মেয়ে পাঠিয়েছে।

আমি তখন অসুস্থ হয়েও সুস্থ থাকার ভান করতে থাকি। এরকমই একদিন আমার প্রচণ্ড রক্তবমি হতে থাকে। এটা আমার বিয়ের প্রায় ৮/৯ মাস পরের কথা। আমি কাউকে না জানিয়ে শুধু আমার হাসবেন্ডকেই বলি ব্যাপারটা। মা আবার আমাদের একসাথে বের হওয়াটা তেমন পছন্দ করতোনা। কোথাও গেলে মা কে সহ নিয়ে যেতে হতো। আর না নিলে উলটো বিচার দিতো আমার মা কে।

তাই ভার্সিটির নাম দিয়েই কাউকে কিছু না জানিয়ে আমরা ডাক্তার এর শরণাপন্ন হই। কিছু টেস্ট করাতে দিয়েছিলো। কিন্তু ওইদিন আর সময় না হওয়ায় টেস্ট করাতে পারি নি। কারন আমাদের ঠিক আমার ভার্সিটি থেকে আসতে যতক্ষণ সময় লাগতো এর মাঝেই বাসায় ফিরতে হতো। এভাবে টাইম মেনেজ করতে করতে আরো বেশ কিছুদিন সময় চলে গেলো। আমার অবস্থার অনেক অবনতির দিকে যাচ্ছিলো। চোখের নিচ কালো হয়ে যাচ্ছিলো। একদিন ডাক্তার দেখাবো বলেই বের হলাম আর টেস্ট গুলো করালাম। দুদিন পর রিপোর্ট আসলো।

আমি তখন হসপিটাল এর বেডে শুয়ে আমার শেষ কিছু সময় পার করছিলাম। এই দিন গুলো অনেক অনেক সুন্দর ছিলো। হয়তো স্ট্রেস ছাড়া লাস্ট দিনগুলো অসম্ভব ভালো লাগছিলো। ও প্রতিদিন সকালে আসতো আর আমরা হসপিটাল এর করিডোরে হাত ধরে হাটতাম। ওর অনেক ভরসা যে আমার কিছু হবেনা। আমি ঠিক সুস্থ হয়ে আমাদের ঘরে ফিরে যাবো।

আমার ঘরে,যেখানে কোনো কষ্ট আমাকে ছুতে পারবেনা। ওর কথাগুলো শুনে আর প্রতিদিন ওর থেকে নতুন বাসা কিভাবে গুছাবে তার বকবক শুনতে শুনতে আমার মাথাব্যাথা হয়ে যেতো। এমনিতেও মাথায় এত ব্যাথা হতো যে পাগলের মতো বেদ এর এই পাশ থেকে ওপাশে কাতরিয়ে বেড়াতাম। ডাক্তার ইঞ্জেক্ট করলে এরপর ঠিক হতাম।

পুত্রবধু

ও আমার হাত ধরে পাশে বসতো। কাঁদোকাঁদো হয়ে বলতো ঘরে যাবো, চলোনা! অনেক হয়েছেতো আর কত শুয়ে থাকবে!! আমার তখন খুব বলতে ইচ্ছে করতো, ইস! যদি তুমি আমায় আরো একটু আগে বাঁচাতে আসতে! আমার যে তোমায় ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হবে!আমার যে খুব বাচতে ইচ্ছে হয় তোমার সাথে!

গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখি যার মৃত্য থেকে জন্ম! এই অসাধারন গল্পটিও আমাদের ওয়েবসাইট থেকে পড়ে নিবেন।

5/5 - (11 votes)

Subna Islam

খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে, গভীর স্বস্তিতে, তৃপ্তিতে বা খারাপ লাগায় এক আল্লাহর কাছে মনের প্রতিটা কথা খুলে বলার মধ্যে যে শান্তি,, তা একবার উপলব্ধি করে দেখুন।

2 Comments

  1. আমি লাস্ট পার্টটুকু ঠিক বুঝলাম না, কি হয়েছিল ওনার,, কোন অসুখ বা রোগ? নাকি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন?

  2. আসলে মানসিক যন্ত্রণা আর টেনশন থেকে মেয়েটার ব্রেইন ডেমেজ হয়ে গিয়েছিলো এবং প্রচন্ড রক্তক্ষরণে উনি মারা যায়।হসপিটাল এ অবস্থানকালীন যেহেতু মানসিক কোনো টর্চার সে ফেইস করেনি,বরং সে অনেক ভালো একটা টাইম তার হাসবেন্ড এর সাথে কাটিয়েছিলো এক্সেপ্ট দ্যা সাফরিংস ফর দ্যা ডিজিজ,তাই ওই পয়েন্টসগুলোও তুলে ধরার ট্রাই করা হয়েছে।এবং এখানে লেখক তাদের স্বপ্ন গুলোরও একটা ঝলক তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন।
    ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button