গল্প

গল্পঃ বিচিত্র জীবন-২য় ও শেষ পর্ব

5/5 - (9 votes)

আমাদের দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবনে ছোট ছোট কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো অবলম্বন করে বাঁচতে হয়। সে সুখময় মুহূর্তগুলো কী তরুণের জীবনে ছিলো না? তরুণকে তা জিজ্ঞেস করতেই সে বললো, ‘সুখ ক্ষণস্থায়ী, দুঃখটাই চিরস্থায়ী। আমার না ছিলো চাকরি, না ছিলো কোনো কোয়ালিটি। অন্তত চেহেরাটা থাকলেও অভিনেতা হতে পারতাম।’
“চেহারা!!”

একটা লাশ চিৎকার দিয়ে উঠল। আমরা দুজন আঁৎকে উঠলাম। লক্ষ্য করলাম আমাদের থেকে দুই মিটার দূরত্বে একটা লাশ। তার মুখটা পুড়ে গেছে। তাই চেহেরা বুঝা যাচ্ছে না।তবে বড় বড় চুল আর সাদা চাদরের নিচে ক্ষাণিক বেড় হয়ে থাকা সালোয়ারটা দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না লাশটা একটা তরুণীর। তার বিভৎস মুখটার দিকে তাকিয়ে আমাদের ঠান্ডা শরীর আরো হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।

‘চেহেরার কথা বলছেন?’
তরুণী বলতে শুরু করলো।
‘এই চেহেরাই আমার কাল হয়ে দাঁড়ালো। সুন্দর চেহেরার কারণে অনেকের কুনজরে পড়েছি। অনেক প্রেমের প্রস্তাব আসতো। কজনকে না করা যায়। তারপরও করতাম।গুটিকয়েক ভদ্র ছেলে বাদে কজনই বা না করার পর আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ায়।

আমার ভয় লাগতো এসব ছেলেদের নিয়ে; তারা না আবার কোন ক্ষতি করে আমার। সেই ভয়টাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো এক যুবকের সাথে। ভালো চাকরি করে। একটা বখাটে ছেলে আমাকে খুব পছন্দ করতো। সে এ বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। গতকাল আমি ভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ায় ছেলেটি। কোন কিছু বুঝার আগেই আমার মুখে এসিড ঢেলে দেয়। আমার সমস্ত মুখমন্ডল সাথে চোখও পুড়ে যায়’
মেয়ের কাহিনী শুনে আমরা দুজনই বেশ মর্মাহত হলাম। কি ভয়ংকর কাহিনী।

মৃত মোজাম্মেল তরুণীর নাম জিজ্ঞেস করলো। নাম শুনে আমার কেন যেন মনে হলো তরুণীকে আমি চিনি। তরুণীর নাম স্বর্ণালি। এই নামের একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। মেয়েটির সাথে আমার কোনদিন কথা হয়নি। শুধু ছবি দেখেছিলাম।আমি অতি উৎসাহের সহিত তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আপনার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তার নাম কি?’

তরুণী নাম বললো। সে সাথে ঠিকানাও বললো যা আমার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে এ মেয়ের সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।।আমার বুকটা হাহাকার করে উঠলো। ফিসফিস করে বুকে পাহাড় সমান কষ্ট নিয়ে মোজাম্মেলকে কথাটা বললাম। কি সুন্দর একটা মেয়ে। তাকে নিয়ে কত শত স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলাম। এখন দুজনই মৃত। তাতে পৃথিবীর কিছু আসে যায় না। আমি ডাকলাম তরুণীকে,

‘স্বর্ণালি?’
‘জ্বি বলেন’
‘তোমার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। আমিই সেই সাইফুল’
তরুণীর চোখ দুটি অত্যধিক পুড়ে যাওয়ায় তাকাতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তার হবু বরকে মৃত দেখে সেও হয়তো একটু চমকে গেছে। ব্যথিতও হয়ে থাকতে পারে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বললো,

‘আমি দুঃখিত সাইফুল সাহেব। আপনার স্বপ্নের বধু হতে পারি নি’
‘এতে তোমার তো কোন হাত নেই। আমাদের ভাগ্যে লেখা ছিলো এটা। তবে তোমার মৃত্যুর সংবাদ তোমার বাবা মা পৌঁছায় নি আমাদের বাড়িতে’

‘মুখ পুড়ে যাওয়ার পরও আমি কয়েক ঘন্টা বেঁচেছিলাম। কেন আপনাদের জানায়নি সেটা বলতে পারবো না। হয়তো আপনারা আমাকে এই অবস্থায় দেখেন সেটা বাবা চায়নি, হয়তো মৃত্যুর সংবাদটা আজকেই দেবে বলে ঠিক করেছিলো আমার বাবা’

‘হয়তো’
স্বর্ণালীর সাথে মতৈক্যে পৌঁছালাম আমি। মোজাম্মেল আমাদের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে। সে হা করে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। সে হয়তে ভাবছে মানুষের জীবন কি বিচিত্র হয়। কেউ পাওয়ার আশায় থেকেও কিছুই মেলেনা আর কারো সামনে পাওয়ার অনেক সুযোগ থাকলেও ভাগ্যের নিষ্ঠুর আঘাতে তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। দুর্ঘটনা না ঘটলে আমাদের জীবনটা খুব সুন্দর হতে পারতো। আমাদের ছেলেমেয়ে থাকতো। একটা সংসার হতো আমাদের। খুব সুন্দর একটা সংসার।

আমি স্বর্ণালীকে বললাম,
‘স্বর্ণালী?’
‘জ্বি বলেন’
‘তোমার ছবিটি প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিন থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। সারাজীবন আগলে রাখার স্বপ্ন’
স্বর্ণালী কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুমের কর্ণার থেকে অন্য একটা লাশ বলে উঠলো,
‘আগলে রাখার কথা বলছেন? ছেলেরা কাউকে আগলে রাখতে পারে নাকি। আগলে রাখার কথা বলে শুধু কষ্ট দিতে পারে’
আমরা তিনজনই সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম রুমের একদম কর্ণারে একটা লাশ উঠে বসে আছে। তার পরনে সুতি শাড়ি। কি রংয়ের সেটা বুঝা যাচ্ছে না। তরুণী উঠে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে এদিকে আসলো। তার হাতে পায়ে কালচে দাগ। কেউ হয়তো শক্ত কিছু দিয়ে খুব মেরেছে তাকে। কাছে আসতেই তরুণীর চেহেরাটা স্পষ্ট বুঝা গেলো। মোজাম্মেল তা দেখে হা করে তাকিয়ে থাকলো। মনে হলো তরুণী তার অনেকদিনের চেনা। তরুণী একবার আমার দিকে আরেকবার স্বর্ণালীর দিকে তাকালো। মোজাম্মেলের দিকে তখনো চোখ পড়েনি। চোখ পড়তেই চমকে উঠে উচ্চসরে বললো, ‘মোজাম্মেল, তুমি এখানে?’
আমিও বেশ চমকালাম। পরে আমার বুুুুঝতে পারলাম, ভার্সিটিতে এই তরুণীর সাথেই মোজাম্মেলের প্রেম ছিলো। পাশে থাকা মোজাম্মেল মাথা নিচু করে বললো,

‘হ্যাঁ।আমি আত্মহত্যা করেছি’
‘সে কি।কেন?কেন তুমি একাজ করতে গেলে?
মোজাম্মেলকে চুপ করে থাকতে দেখে আমি বললাম,’চাকরি না পাওয়ার হতাশায়’
শুনে মেয়েটির কোন ভাবান্তর নেই।শুধু তার চোখগুলো ছলছল করছিলো।জীবিত থাকতে মোজাম্মেলের আত্মহত্যার কথা শুনলে মেয়েটি হয়তো আকাশ ফাটা চিৎকার দিয়ে আর্তনাদ করে উঠতো।
মোজাম্মেল নিরবতা ভেঙে তরণীর ক্ষতস্থানগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘তোমাকে এইভাবে মেরেছে কে?’
‘আমার স্বামী আর শাশুড়ি’
‘সে কি কেন মেরেছে?কি করেছিলে তুমি?’

‘গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর চাকরির জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম।কিন্তু আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা এটা মেনে নেয়নি।তারা চায় আমি যেন শুধু ঘর সংসার দেখি।পড়ার টেবিলে বসলেই আমাকে কথা শুনতে হতো।টেবিল ছেড়ে না উঠলে রুটি বানানোর বেলুন নিয়ে এসে মারত।এজন্য মাঝে মধ্যে বাপের বাড়ি চলে আসতাম।কিন্তু আমার শাশুড়ি বাপের বাড়িতে বেশিদিন থাকতে দিতো না।আমার বাবা মাকে হুমকি দিতো,যদি বাপের বাড়িতে থাকে তাহলে একেবারে যেন আমাকে সেখানে রেখে দেওয়া হয় ।তারা আর নিতে আসবে না। এই জন্য বাবা মা আমাকে জোর করে ঠেলেঠুলে শ্বশুর বাড়ি পাঠাতো’
তরুণী একটু থামলো। আমি স্বর্ণালীর দিকে একবার তাকিয়ে তরুণীর দিকে ফিরলাম।বললাম,

‘তারপর?তারপর কি হলো?’

তরুণী আবার বলতে শুরু করলো,
‘নির্যাতন সহ্য করেও আমি পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝে মধ্যে আমাকে উপোষ থাকতে হতো। শাশুড়ি খেতে দিতো না আমাকে। তারা যেন আরো হিংস্র হয়ে উঠলো।একদিন স্বামী আর শাশুড়ি প্রচুর মারলো আমাকে। আমি বমি করে দিলাম কয়েকবার।কাতরাতে কাতরাতে শেষ পর্যন্ত হেরে গেলাম জীবনের কাছে’

মোজাম্মেল ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। আমি ভাবছি মেয়েটি কি অমানসিক যন্ত্রণা উপভোগ করে এখানে এসেছে। সামান্য পড়ালেখা আর চাকরি করা নিয়ে এরকম নির্যাতন। পাশ থেকে মোজাম্মেল বললো,

‘আমার কাছে চলে আসলে না কেন, শিলা? আমার বাবার যেটুকু জায়গা জমি আছে সেখানে চাষবাষ করে সংসার করতাম আমরা। তুমি পড়াশুনা করে একটা চাকরি নিলে তখন আর আমাদের কোন অভাব থাকতো না’

মোজাম্মেলের কথা শুনে মেয়েটি শুধু চোখের পানি ফেললো। মোজাম্মেল যা বলেছে তা শুধুই আবেগ। বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। অনেক মেয়ে আছে যারা শত নির্যাতন সহ্য করেও মা বাবার কথা চিন্তা করে শশুর বাড়িতে পড়ে থাকে। শিলা ঐ টাইপের মেয়ে।মোজাম্মেলকে ভালোবাসলেও সে মা বাবার দিকে চেয়ে অন্য একটা পরিবারে বউ হয়ে যায়।

মোজাম্মেল বাদে আমরা বাকি তিনজনের কেসটা একরকম। এখানে মামলা মোকদ্দমা হবে। আমাদের মৃত্যুর সাথে যারা জড়িত তাদের জেল জরিমানা কিংবা ফাঁসি হবে। কিন্তু মোজাম্মেল যে আত্মহত্যা করেছে; তাতে করে তার পরিবার কোন ক্ষতিপূরণ ও পাবে না, তাকে হত্যার দায়ে কারো জেল, জরিমানাও হবে না। খারাপ চেহারা, চাকরি না পাওয়ার হতাশা, প্রেমিকার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাওয়া এতসব বেদনার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে অন্ধকার জগতে পড়ে গিয়ে সেখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত মোজাম্মেল কি বেঁচে থাকার কোন অবলম্বন পেয়েছিলো?

পাইলেও হয়তো তা যথেষ্ট ছিলো না। তার জায়গায় আমি হলে কি একই কাজ করতাম?হয়তো করতাম, হয়তো না। কিন্তু তাতে কি। আমিও তো এখন মৃতই, কারণটা যা ই হোক না কেন। একটু পর ডাক্তার এসে ব্যবচ্ছেদ করে চলে যাবে। আমাদের তিনজনেরটা হত্যা আর মোজাম্মেলেরটা আত্মহত্যা বলে জানাযা পড়িয়ে কবর দেওয়ার জন্য আমাদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিবে। মানুষের জীবনের মতো মৃত্যুও বিচিত্র হয়। যাই হোক, সে মৃত্যুতে পৃথিবীর কোন যায় আসে না।

বিচিত্র জীবন-১ম পর্ব

zahid

A professional SEO Expert & Digital Marketing Consultant. Enhancing online visibility of business is my job. Keeping update myself with new search algorithm update and stay top on search results is my passion.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button