গল্পঃ বিচিত্র জীবন-১ম পর্ব
আজকে বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ পিছন থেকে প্রচন্ড গতিতে একটা লেগুনা এসে আমাকে ধাক্কা দিলো। মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়ায় আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। পরিস্থিতি দেখে আমাকে কয়েকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ডাক্তার আমাকে চেক করে তাদের উদ্দেশ্যে বললো, ‘He is dead’
হাসপাতালে আনার সময় পথিমধ্যেই আমার মৃত্যু হয়। উনারা সেটা বুঝতে পারেননি। মনে করেছিলেন যে আমি হয়তো ব্লিডিংয়ের কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
সকলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। একজন বলল,
‘উনার বাসায় খবর দেয়া দরকার।’
আরেকজন এসে আমার ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বের করলো। ঐগুলোতে আমার বাসার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লেখা আছে। অতপর তিনি তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে আমার বাসায় ফোন করলেন। বাকিরা বলাবলি করছে,
‘ড্রাইভার শালাটাকে ইচ্ছেমতো পিটুনি দিচ্ছে সবাই।’
এরপর কয়েকঘন্টা কেটে গেলো। হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে রুমে ঢুকলো মার মা। তার পেছনে বাবা আর ছোট বোনটাকেও দেখতে পেলাম। তারাও কাঁদছে। আমার মায়ের কান্না দেখে তাকে স্বান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে করছিলো।
‘মা, কেঁদো না। মানুষ তো আর চিরদিন বেঁচে থাকে না। আগে বা পরে সবাইকেই মরতে হয়’
ছোটবেলায় আমার একটা কঠিন রোগ হয়েছিলো। মা সারাদিন সারারাত আমার সেবা করলো। খোদার কাছে প্রার্থনা করলো কেঁদে কেঁদে। বাবার কাছে কোন জিনিস চাইলে না করতেন না। শত কষ্ট করে হলেও তিনি সেটা জোগাড় করে দিতেন আমাকে।
আমি বোনটার দিকে তাকালাম। সে আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ছোটবেলায় বৈশাখী মেলা থেকে খেলনা কিনে দিতাম। একবার পাশের বাড়ির জামাল কাকার ছেলে তার কাছ থেকে একটা খেলনা কেড়ে নেয়। আমার বোনের সে কি কান্না!!তার কান্না দেখে আমি ছেলেটার কাছ থেকে খেলনাটা ফিরিয়ে আনি। আজকে আমার বোন কাঁদছে হয়তো আমাকে ফিরে পাবার আশায়। কিন্তু মানুষ তো আর খেলনা না যে কাঁদলে ফেরত পাওয়া যাবে।
আমাকে মর্গে পাঠানো হলো। আমার মা বাবা ডাক্তারকে অনুরোধ করলেন, আমার যেন ব্যবচ্ছেদ করা না হয়। পাশ থেকে পুলিশ তাদেরকে আশ্বস্ত করে বললো যে, কাঁটা ছেঁড়া না করে সমান্য পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ছেড়ে দেওয়া হবে।
মর্গের পরিবেশটা শ্মশানঘাটের মতই নীরব, নিস্তব্ধ। আগে শ্মশানঘাটের নাম শুনলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো। শুনতাম, সেখানে নাকি মৃত মানুষরা হাঁটাহাঁটি করে। তাই রাতের বেলা তো দূর থাক, দিনের বেলাতেও শ্মশানঘাটের পাশ দিয়ে যেতে ভয় লাগতো। মর্গের পরিবেশটা শ্মশানঘাটের মতোই ভীতিকর। অবশ্য তাহা জীবিতদের কাছে, আমাদের কাছে নয়।
বাইরে থেকে একটা আবছা আলো মর্গের ভিতরে এসে পড়েছে। সেই আলোয় দেখলাম এক তরুণের লাশ পড়ে আছে আমার পাশের বেডে। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। শ্যাম বর্ণের ঐ তরুণের মাথায় কুঁকড়া চুল। গলায় একটা দাগ রয়েছে। দাগটা সামনের দিকে গোলাকার হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। সে এক মনে কী যেন ভাবছে। আমি কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুমি কে তরুণ? কীভাবে মারা গেলে?’
তরুণ সম্বিত ফিরে পেয়ে আমার দিকে তাকালো। বললো,
‘আমি এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। চাকরি না পাওয়া হতাশাগ্রস্ত এক যুবক। নিজেকে আত্মাহতি দিয়েছি।’
তরুণের কথায় আমি অবাক হলাম না। কারণ জীবিত অবস্থায় এরকম অসংখ্য তরুণের আত্মহননের খবর পত্রিকায় পড়েছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘তোমার মনে কী এমন কষ্ট ছিল যে এই পথ বেছে নিলে?’
‘সে অনেক কাহিনী?’
‘তোমার সেই দুঃখ ভারাক্রান্ত কাহিনী আমাকে শুনাবে?’
‘আফসোস। জীবিত থাকতে আমার গল্পটা কেউ শুনতে চায়নি। পর্বতসম কষ্ট নিয়ে দিন পার করা রক্তে মাংসে গড়া এক স্তন্যপায়ীর গল্প।’
বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তরুণ। পরক্ষণে আবার বললো,
‘এখন আর এগুলো শুনে কী হবে। আমি তো আর পৃথিবীতে ফেরত যাবো না।’
আমি বললাম, ‘জীবিত অবস্থায় অনেক সংগ্রামী মানুষের জীবন কাহিনী শুনতাম। শুনেছি দুবেলা খেতে না পারা ছেলেটার লাখপতি হওয়ার গল্প। কিন্তু জীবন সংগ্রামে হেরে যাওয়া কারো গল্প তার নিজের মুখ থেকে শুনি নি। আজ সেই সুযোগ হয়েছে। আমাকে নিরাশ করো না।’
তরুণ অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। আমি আশা ছেড়ে দিলাম। ভাবলাম তরুণকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ বলতে শুরু করলো তরুণ,
‘আমার বাবা হলেন কৃষক। অভাব অনটনের সংসারে আমরা দুই ভাই, এক বোন। আমি সবার বড়। বাবা আমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় অফিসার বানাতে চেয়েছিলেন। বাবা বলতেন যে কৃষিকাজ অনেক কষ্টের কাজ। আমরা যেন পড়ালেখা শেষে চাকরি করে সংসারটা ভালোমতো চালাই। তাই বাবা মা না খেয়ে অনেক কষ্ট করে আমাদের পড়ালেখার খরচ চালাতেন।’
তরুণ একটু থামলো। এই মুহূর্তে একটা সিগারেট ধরাতে মন চাইলো আমার। কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম, আমি তো জীবিত নই, মৃত। আর মৃত মানুষরা তো ধূমপান করতে পারে না।
তরুণের দিকে তাকালাম। দেখলাম তরুণ কাঁদছে। এখনই ভেঙে পড়লে হবে!! গল্প তো সবটাই বাকি। আমি তরুণকে তার মন শক্ত করতে বললাম।
তরুণ তার মনটাকে শক্ত করলো। আবার বলতে শুরু করলো সে।
“আমি ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে গেলাম। কোচিং করার টাকা নেই। বাবা জমি বন্ধক রেখে আমার হাতে টাকাটা দিয়ে বলেছিলেন, ভাল করে পড়ালেখা কর। টাকার জন্য চিন্তা করিস না।
ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মোটামুটি একটা ভাল ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। সাবজেক্টটা তেমন ভালো ছিলো না। ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষে উঠে আমি একটা মেয়ের প্রেমে পড়ি, যেটা আমার জন্য অনুচিত ছিলো। কারণ লেখাপড়া বাদ দিয়ে কারো প্রেমে পড়া মানে আমার দরিদ্র পরিবারকে ঠকানো। কিন্তু কি করবো। অন্যদের মত আমারও তো ইচ্ছে হয় কারো হাত ধরে হাঁটার।
মনের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে আমি মেয়েটাকে প্রপোজ করি। মেয়েটা রাজি হয়ে যায়’
কথা বলতে বলতে তরুণের গলা ধরে আসলো। এই মুহূর্তে এক কাপ চা খাওয়া দরকার ছিলো তার। কিন্তু মৃতরা তো চা খেতে পারে না। জীবিত থাকতে চায়ের সাথে একটা সিগারেট আমার কাছে অমৃত লাগতো। বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যাবেলায় যখন আড্ডা দিতাম তখন এক কাপ চা না হলে আড্ডাটাই জমতোই না। তরুণকে একটু বিরতি নিয়ে আবার কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম। তরুণ তাই করলো।
“মোটামুটি একটা রেজাল্ট নিয়ে ভার্সিটি লাইফ শেষ করলাম। তারপর আদা জল খেয়ে লেগে চাকরির পড়াশুনা করলাম। দুই তিন বছর কেটে গেলো কিন্তু চাকরি পেলাম না।কখনো রিটেনে, কখনো বা ভাইভায় বাদ পড়েছি। প্রাইভেট কম্পানিতে গেলে বলতো এক্সপেরিন্স নাই। এদিকে আমার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেলো। বাড়িতে কম যেতাম। গেলে সবাই শুধু চাকরির কথা বলতো; কোনো চাকরি হয়েছি কিনা আমার। আর ছোট ভাই বোন দুইটা আমার ব্যাগ ঘাটতো, জানতে চাইতো যে, তাদের জন্য কিছু এনেছি কিনা।
মায়ের পুরাতন শাড়িটাতে একটার পর একটা সেলাই পড়ে, বাবার নীল শার্টটা বারবার ধোয়ার ফলে রঙ হালকা হয়ে উঠে, টিনের চালটায় মরিচা ধরে যায়, আমার চাকরি আর মেলে না।”
যুবকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। আমি অনুভূতিহীন একজন মানুষ। কিন্তু কেন জানি আজ কান্না থামাতে পারি নি। মনের অজান্তে চোখের কোণে জল এসে ভিড় করলো।খেয়াল করলাম যুবকও কাঁদছে।
“আমি পরিবার ও সমাজের কাছে বুঝা হয়ে গেলাম। সমাজের মানুষ আমার উপর বিদ্রুপ করতো। আমাকে ছোট করে দেখা শুরু করলো। অসহ্য যন্ত্রণায় রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতাম। কান্না করে বালিশ ভিজিয়ে ফেলতাম। আমার এই কান্নার দাম পাইনি কারো কাছে, স্বয়ং ঈশ্বরের কাছেও না। আর্টসের স্টুডেন্ট হওয়াতে তেমন একটা টিউশনি পেতাম না। যেটা পেতাম সেটা দিয়ে কি আর চলে। মাঝে মধ্যে স্টুডেন্টের গার্ডিয়ান টাকাও মারতো।
চাকরির বয়সে পরিবার থেকে টাকা চাওয়া যে কি পরিমাণ যন্ত্রণা সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আর সহ্য হচ্ছিলো না। ভাবলাম, নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। গতকাল বিকেলে বাজার থেকে মোটা দড়ি কিনে নিয়ে আসলাম। ফ্যানের সঙ্গে দড়িটা বাধার সময় মনে হলো কেউ একজন বলছে, মরিস না যুবক। তুই মরে গেলে তোর পরিবারের কি হবে?
আবার আরেকজন বলছে, মরে যা যুবক। তোর বেঁচে থাকার কোন কারণ নেই।”
একটু থামলো তরুণ। তারপর আবার বললো,
“দ্বিতীয় জনের বিজয় হলো আমি ফ্যানে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়লাম। মৃত্যুর সময় আমি কোন চিৎকার করিনি পাছে আশেপাশের লোকজন আমাকে বাঁচিয়ে ফেলে।”
তরুণের বক্তব্য শেষ হলো। সে নীরবে চোখের পানি ফেলছে। আমিও কাঁদছি। তরুণের নাম জিজ্ঞেস করা হলো না। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করাতে সে বললো তার নাম মোজাম্মেল। আমি নামটা শুনে আৎকে উঠলাম। কারণ গতকাল মোজাম্মেল নামের একজনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিজের হাতে লিখেছিলাম। আমি বললাম, “তুমি কি সেই মোজাম্মেল যে আমাদের কোম্পানিতে অ্যাপ্লাই করেছিলে?”
“আপনাদের কোম্পানির নাম কি?” জিজ্ঞেস করলো তরুণ।
আমি নাম বললাম। তরুণ বললো,
“অনেক আগে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা আর কয়েকটা ঘন্টা আগে আসলে বেঁচে যেতাম আমি। আমার মা যখন লেটারটা নিয়ে আমার লাশের পাশে বসে আমাকে জড়িয়ে দরে কাঁদছিলেন তখন মনে হয়েছিলো, আবার যদি সুুযোগ পেতাম তাদের কাছে ফিরে যাওয়ার।’
সে জিজ্ঞেস করলো, “সৃষ্টিকর্তাকে বলে কোনভাবেই কি আবার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, “তা আর সম্ভব নয় ভাই।”