বাড়ি নির্মান করার পূর্বে যে প্রয়োজনীয় ধাপসমূহ আপনার জানা আবশ্যক
আপনি কি আপনার স্বপ্নের বাড়ি নির্মান করার জন্যে প্ল্যানিং করছেন?
কিন্তু বুঝতে পারছেন না কোথা থেকে কি শুরু করবেন?
ছোটবেলা থেকে আমাদের সবার একটা নিজস্ব বাড়ি বানাবার স্বপ্ন থাকে, হোক সেটা ছোট বা বড়, বিলাসবহুল কিংবা দুই থেকে তিনতলার পিলার ফাউন্ডেশন বা ডুপ্লেক্স বাড়ি।
তবে স্বপ্ন যেটাই হোক না কেন, বাড়ি নির্মাণ পদ্ধতি অনেক কষ্টসাধ্য, এজন্য আপনাকে অবশ্যই কিছু আইনি পদক্ষেপ মেনে চলতেই হবে।
আইনি পদক্ষেপ ছাড়া কিংবা রাজউকের অনুমোদন ছাড়া আপনার কষ্টে গড়া নীড় অবৈধ ব্যবস্থাপনা বলে বিবেচিত হবে।
আর তাই আপনার স্বপ্নের পথের অন্তরায় এই ধরণের আইনি ঝঁক্বি যাতে না পোহাতে হয়, তাই আজকের লেখায় আমরা আলোচনা করবো, বাড়ি তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় আইনি ধাপ যা আপনার জানা একান্ত জরুরি।
Contents
যেসব পদক্ষেপসমূহ আপনার জানা আবশ্যক
বাড়ি বানানোর জন্যে সবার প্রথমে আপনি কি করবেন। হয়তো আপনি ব্যাংক লোনের কথা চিন্তা করবেন অথবা আপনার কাছে থাকা সঞ্চিত অর্থ দিয়েই বাড়ি বানানোর চিন্তা করবেন। এর পরবর্তী ধাপে আপনি হয়তো রড, সিমেন্ট প্রভৃতি ক্রয়ের কথা চিন্তা করবেন। কিন্তু এসব কিছুর আগে আইনি ঝামেলা এড়াতে নিচের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আগেভাগে গুছিয়ে রাখুন।
- বিল্ডিং প্ল্যান করা
- ফাউন্ডেশন
- ভবনের তলা বা উচ্চতা নির্ণয়
- ইউটিলটি কানেকশন
- সয়েল টেস্টিং
- টেক্স এর ছাড়পত্র
বিল্ডিং প্ল্যান করা
বাড়ি তৈরির আগমুহূর্তে আপনাকে যেই ধাপটির দিকে আপনাকে সর্বপ্রথম জোর দিতে হবে সেটি হচ্ছে বিল্ডিং প্ল্যান করা। এই বিল্ডিং প্ল্যানের যদি আপনার কাছে না থাকে অনুমোদন তাহলে আপনার পুরো বাড়ি তৈরির পরিকল্পনাই বেহেশতে যাবে।
আপনার বাড়ির জমিটি যদি সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত না থাকে তাহলে আপনাকে অবশ্যই সিটি কর্পোরেশনের নকশা অনুমোদন শাখা থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। আর যদি জমিটি সিটি কর্পোরেশনের না হয়ে রাজউকের মধ্যে হয়ে থাকে তাহলে রাজউক অফিস থেকে আপনাকে নকশার অনুমোদন নিতে হবে।
এছাড়াও আপনাকে এর পাশাপাশি যোগাযোগ করতে হতে পারে স্থানীয় সরকার, জেলা অফিস, উপজেলা অফিস এবং ইউনিয়ন অফিস থেকে। আসলে পুরো ব্যবস্থাটাই নির্ভর করছে আপনার জমির লোকেশনের উপর। জমির লোকেশন অনুযায়ী পুরো ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে কিন্তু ছাড়পত্র গ্রহণের শাখা বা ডিপার্টমেন্ট একই রকম থাকছে।
এছাড়াও খেয়াল রাখবেন ছাড়পত্র গ্রহণের শাখা বা ডিপার্টমেন্টটি এক আছে কি না। আর অবশ্যই বিল্ডিংটি যাতে আইএবি দ্বারা রেজিস্টার্ড আর্কিটেক্ট দ্বারা বিল্ডিং এর খসড়া তৈরি করা হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন থাকতে পারে, কেন রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্কস দ্বারা বা আর্কিটেক্ট দ্বারা বিল্ডিংটি প্ল্যান করবেন।
এখানে একটি কথা জানিয়ে রাখা ভালো, সরকারি দফতরে রেজিস্টার্ড পাওয়ার জন্যেও আপনার বিল্ডিংয়ের ডিজাইনেশন কতটা পাকাপোক্ত এবং রেজিস্টার্ড আর্কিটেক্ট দ্বারা অনুমোদিত কিনা সেটাও দেখা হয়ে থাকে।
আর আপনি যদি আগে ভাগেই ভালো প্রফেশনাল রেজিস্টার্ড দ্বারা বিল্ডিং প্ল্যান করিয়ে ফেলেন তাহলে বাড়ি বানানোর জন্যে আপনি আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন।
রেজিস্টার্ড ফাউন্ডেশন
বাড়ি বানানোর আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে তৃতীয় ধাপটি হচ্ছে রেজিস্টার্ড ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশন তৈরির জন্যে সবচাইতে যেটা বেশি জরুরি সেটি হচ্ছে সরকারি দফতর থেকে ছাড়পত্র পাওয়া। আর ছাড়পত্র পেতে গেলে সবচাইতে বেশি জরুরি হচ্ছে ফাউন্ডেশনের দিকে জোর দেওয়া।
ফাউন্ডেশন মূলত দু’ধরণের হয়ে থাকে।
১. গভীর ভিত্তি এবং
২. অগভীর ভিত্তি
বাড়ি তৈরির আগে যে ধরণের ফাউন্ডেশনই আপনি বেছে নেন না কেন, খেয়াল রাখবেন ভবনের লোড বা ক্যাপাসিটি অনুযায়ী আপনি ক’তলা ভবন করতে চাচ্ছেন সেই অনুযায়ী যাতে প্ল্যানপাশে উল্লেখ্য থাকে।
সুতরাং বিল্ডিং প্ল্যানটা আপনি করছেন আর্কিটেক্ট দ্বারা এবং ফাউন্ডেশন প্ল্যান করতে হবে আইইবি দ্বারা, রেজিস্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা। ফাউন্ডেশনের স্ট্রাকচারাল প্ল্যানটা অবশ্যই আইইবি দ্বারা অনুমোদিত ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা জাস্টিফাইড হতে হবে। আর না হলে, “নকশা অনুমোদন শাখা থেকে বাতিল হবার সম্ভাবনা রয়েই যাবে।
ভবনের উচ্চতা বা তলা বিষয়ক রেজিস্টার্ড ফাউন্ডেশন
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে আপনি যেই ধরণের বিল্ডিং তৈরি করেন না কেন, ভবনের উচ্চতা বা তলা বিষয়ক রেজিস্টার্ড ফাউন্ডেশনের দিকে নজর দেওয়া। ভবনের উচ্চতা বা তলা রেজিস্টার্ড হচ্ছে বিল্ডিং বা কন্টস্ট্রাকশন আইনের ফ্লোর এরিয়া রেশিও এর পরিমাণ (এফএআর)।
এর অর্থ হচ্ছে এফএআর অনুযায়ী জমির পরিমাণ, ভবনের সামনের রাস্তার প্রশস্ততা ইত্যাদি দেখে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা এবং সেই অনুযায়ী নকশা প্রণয়ণ করা। এরপর, আপনাকে ফ্লোরের উচ্চতা ক্লিয়ারেন্সের জন্য “সিভিল এভিয়েশন অথরিটি” থেকে পুনরায় একটি অনুমোদিত ছাড়পত্রের জন্যে আবেদন করতে হবে। যদিও বা ভবনের উচ্চতা নির্ভর করে থাকে এর সামনের রাস্তার পরিমাণের উপর।
উদাহরণস্বরূপ, ধরুণ আপনার বাড়ির সামনে একটি ৬০ ফিটের বেশি প্রশস্ত রাস্তা রয়েছে তাহলে আপনি সহজেই অনুমোদন পেয়ে যাবেন। কিন্তু যদি ভবনের সামনে ৬০ ফিট বা এর কম প্রশস্ত রাস্তা থেকে থাকে তাহলে আপনাকে হয় নকশা পরিবর্তন করতে হতে পারে বা অন্য উপায় অবলম্বন করতে হতে পারে।
আবার যদি ভবনটি বিমানবন্দরের বা সামরিক বাহিনীর আশেপাশের এলাকায় হয়ে থাকে তাহলে সিভিল এভিয়েশন থেকে ছাড়পত্র আপনাকে অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে।
ইউটিলিটি কানেকশন
এবার আসুন চতুর্থ ধাপ নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই ধাপটি আপনার স্বপ্নের নীড়ের অন্যতম কাঠামো। কারণ পর্যাপ্ত গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছাড়া কখনোই একটি বাসযোগ্য আবাসস্থল কল্পনা করা সম্ভব নয়। আর তাই সবার প্রথমে আপনাকে এই সার্ভিসগুলোর জন্যেও বৈধতা আনয়নে সোচ্চার হতে হবে।
এর জন্যে সবার প্রথমে আপনাকে যোগাযোগ করতে হবে আপনার এলাকা বা শহরের সিটি কর্পোরেশন অথবা পল্লীবিদ্যুৎ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অফিসে। এছাড়াও বিদ্যুৎ সংযোগের জন্যে পিডিবি, ডিইএসএ, ডিইএসসিও, ডিপিডিসি এর অফিসে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার মাধ্যমে।
আর পানির জন্যে ওয়াসাতে এবং গ্যাসের জন্যে তিতাস বা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আবেদন করতে হবে। আবেদনপত্র মঞ্জুর হলে আপনার সংযোগ স্থাপনের কাজ আরম্ভ করতে হবে। আর অবশ্যই এলাকাটি রাজউকের আওতাধীন হলে আপনাকে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট অবশ্যই নিতে হবে।
সয়েল টেস্ট বা মাটি পরীক্ষা
বাড়ি তৈরির পুর্বে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি ধাপ হচ্ছে সয়েল টেস্টিং। সয়েল টেস্টিং আপনার বাড়ি বা ভবনের পাকাপোক্তটার উপরে অনেকাংশে নির্ভর করে থাকে। এজন্যে আপনাকে প্রথমেই শরণাপন্ন হতে হবে একজন দক্ষ জিওটেক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে।
যদিও অনেকে এই জিনিসটি মারাত্মকভাবে অবহেলা করে থাকেন। তবে আমি বলবো আপনার সারাজীবনের কষ্টার্জিত অর্থে তৈরি বাড়ির ভিত্তিই যদি দুর্বল হয় তাহলে আপনার স্বপ্ন ও ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেতে সময় লাগবেনা। আর এখন বাড়ি তৈরির আগে সরকারি ভূমি অফিসগুলোও এসব বিষয়ে বেশ খতিয়ে দেখে থাকেন।
আর হ্যা মাটি পরীক্ষার জন্যে অবশ্যই একজন ভালো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের সাথে পরামর্শ করে নিন। কেননা একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ই বলতে পারবে আপনাকে কত গভীরতায় কতটুকু বোরিং করতে হবে।
টেক্স বা কর সংক্রান্ত ছাড়পত্র
বাড়ি তৈরির আগে জমির বকেয়া খাজনা মিটিয়ে নতুন করে প্ল্যান পাশ করার পাশাপাশি টেক্সের ঝামেলাটাও সেরে নেওয়া ভালো। এতে করে কর ফাঁকির জন্যে অযথা বছর শেষে আপনাকে জরিমানা গুণতে হবেনা। আমাদের মধ্যে অনেকেই টাকা বাঁচানোর জন্যে টেক্স এর ব্যাপারে গড়িমসি করে থাকি। যা নিতান্তই বোকামি।
কেননা বছর শেষে আপনি আপনার বাড়ির টেক্স ক্লিয়ার রাখলে তা দিনে দিনে বেড়ে একটা বিশাল টাকার অংকে পরিণত হবেনা। তাই ঝামেলা এড়াতে একজন দক্ষ কর বিষযয়ক আইনজীবীর সহিয়তায় কর কমিশন মন্ত্রণালয়ে নতুন করে আবেদনপত্র জমা করুন এবং প্রথম বছর থেকেই টেক্স এর ব্যাপারটা খোলাসা করে রাখুন।
শেষ কথা
এই তো, উপরের এই ছয়টি ধাপগুলোকে মাথায় রেখে চললেই দেখবেন আপনার বাড়ি নির্মাণের পথে আর কোন বাঁধা নেই। আপনি নির্বিঘ্নে একটি সুন্দর বাড়ির মালিকানা পেয়ে যাচ্ছেন।
তবে কথা সত্য যে, কম ঝামেলা ছাড়াই একটি জমির মালিক হওয়া গেলেও একটি বাড়ি বা ভবনের মালিক হতে গেলে আপনাকে বেশ বড় রকমের ঝক্কি পোহাতে হবে। কেননা সরকারি অফিসগুলোতে অনুমোদন পেতে পেতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে।
উপরন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে বাড়ি তৈরির আগে আপনাকে ধারণা নিতে হবে কয়েকটি বাড়ির মডেলের, শরণাপন্ন হতে হবে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের, এছাড়াও কাঠা প্রতি কোন ধরণের বাড়ি বা ভবন আপনার জায়গার সাথে সামাঞ্জস্য ইত্যাদি। তাই সবকিছু মাথায় রেখেই লেগে পড়ুন আপনার স্বপ্নের বাড়ি তৈরির কাজে।
আরো পড়ুনঃ