বিজ্ঞান

বায়ু বিদ্যুৎ এবং বাংলাদেশে সম্ভাবনা

উইন্ড টার্বাইনের মাধ্যমে বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমান পৃথিবী নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুকছে। ভূ শক্তি এবং জোয়ার ভাটা বাদে প্রায় সকল নবায়নযোগ্য শক্তি আসে সূর্য থেকে। পৃথিবী সূর্য থেকে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ১.৭৪*১০^১৭ ওয়াট শক্তি শোষণ করে থাকে। প্রাপ্ত শক্তির প্রায় ১% অথবা ২% বায়ুশক্তিতে রুপান্তরিত হয় ,যা পৃথিবীর সকল গাছপালা পচিয়ে যে জৈবশক্তি পাওয়া যাবে তার সমান।
বায়ুশক্তি নিয়ে কাজ করার সময় মূলত ভূতলের বায়ু বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বায়ুচালিত টার্বাইন তার ঘুর্ণনশীল পাখায় প্রাপ্ত বাতাসের বলকে কাজে লাগিয়ে টর্কে রুপান্তরিত করে। একটি টার্বাইন কি পরিমান শক্তি রুপান্তরিত করতে পারবে সেটা নির্ভর করবে বায়ুর ঘনত্ব,বায়ুর গতিবেগ এবং পাখার ক্ষেত্রফলের উপর। আমরা জানি যে, কোন গতিশীল বস্তুর গতিশক্তি তার ভরের সমানুপাতিক। তেমনি বায়ুর গতিশক্তি তার ঘনত্বের উপর নির্ভর করে। কারন, ঘনত্ব বলতে একক আয়তনের ভরকে বুঝায়। অন্য কথায়,বায়ু যত ভারি হবে তত বেশী পরিমান শক্তি রূপান্তরিত হবে। ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রতি ঘনমিটার বাতাসের ওজন প্রায় ১.২২২৫কেজি। কিন্তু আর্দ্রতা বাড়ার সাথে সাথে বাতাসের ঘনত্ব কমতে থাকে।

যেভাবে স্থানীয় বায়ূপ্রবাহ সৃষ্টি হয়ঃ

বায়ুমন্ডলে সূর্যের অসমান তাপ প্রদান,পর্বতমালা এবং উপত্যকার কারণে পৃথিবীর সৃষ্ট অসমান ভূ-তল,এবং সূর্যের চারিদিকে গ্রহগুলোর আবর্তনের কারনে বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়।

ক)জলভাগ এবং স্থলভাগের অসমান তাপঃ

স্থলভাগের উপরিভাগে বায়ূমন্ডল অধিক উত্তপ্ত হয় ,কারন স্থলভাগ জলভাগের চেয়ে অধিক তাপ শোষণ করে থাকে। স্থলভাগের অধিক উত্তপ্ত বায়ু হাল্কা হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। ফলে স্থলভাগের উপরে বায়ুশুন্যতা সৃষ্টি হয়। সেই শুন্যতা পূরণ করতে সমদ্রের শীতল বায়ু স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এই ঘটনাকে বলা হয় সী ব্রীজ(Sea Breeze) ।

আবার রাতে যখন সূর্যের উত্তাপ থাকে না ,তখন স্থলভাগ অতি দ্রুত তাপ বর্জন করে। ফলে এর উপরিভাগের বায়ু অতি দ্রুত শীতল হতে থাকে । কিন্ত সমুদ্র পৃষ্ঠ স্থলভাগের মত এত দ্রুত তাপ বর্জন করতে পারে না। এভাবে রাতের বেলা স্থলভাগ থেকে জলভাগের দিকে বায়ুপ্রবাহিত হতে থাকে। এই ঘটনাকে বলা হয় ল্যান্ড ব্রীজ(land Breeze)। সুতরাং দিনের বেলা স্থলভাগ অধিক উত্তপ্ত হয় এবং সমুদ্র থেকে স্থলভাগের দিকে বায়ু প্রবাহিত হয় , আর রাতের বেলা তার উল্টো ঘটনা ঘটে থাকে।

খ)অসমান ভূ-তলঃ

 বিভিন্ন পর্বতমালা এবং উপত্যকার কারণে পৃথিবীর পৃষ্ঠ সব জায়গায় সমান নয়। পার্বত্য এলাকার বায়ুমন্ডল নিচু ভুমির চেয়ে দিনের বেলায় তুলনামুলক বেশী উত্তপ্ত হয় এবং রাতেও বেশী পরিমানে শীতল হয়। ফলে বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়।

গ) পৃথিবীর ঘুর্ণনঃ

পৃথিবী নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে পুর্ব থেকে পশ্চিমে ঘুরছে। এই ঘুর্ণনের কারণে বায়ুপ্রবাহের দিক হয় বক্ররেখা। উত্তর গোলার্ধে বায়ু প্রবাহের দিক ডান দিকে মোর নেয় এবং ঘড়ির কাটার দিকে প্রবাহিত হয়। দক্ষিন গোলার্ধে বায়ুপ্রবাহ বাম দিকে মোর নেয় এবং ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়।

বায়ুশক্তির রূপান্তর প্রক্রিয়া এবং বায়ুকলঃ

বায়ুশক্তিকে অন্য শক্তিতে রুপান্তরিত করার অতি পরিচিত যান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে বায়ুকল। বায়ুকলে ব্লেড নামে কতগুলো পাখা থাকে। সেই পাখাগুলো ভুপৃষ্ঠ থেকে উপরে এমনভাবে স্থাপন করা হয় যে ,যখন বায়ু পাখার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন এর পাখা বায়ু প্রবাহের কারণে ঘুরতে থাকে। এই ঘুর্ণনশীল পাখাগুলো টারবাইনের সাথে যুক্ত থাকে এবং পাখার সাথে সাথে টারবাইনও ঘুড়তে থাকে। টারবাইনকে একটি বৈদ্যুতিক জেনারেটর এর সাথে যুক্ত করা হয় যা টারবাইনের যান্ত্রিক শক্তিকে বিদ্যুত শক্তিতে রুপান্তর করে। ব্লেড বা পাখাগুলোকে এমন ভাবে স্থাপন করা হয় যেন এতে সর্বোচ্চ পরিমানে ঘুর্ণন শক্তি উৎপন্ন হয়। ঘুর্ণনশক্তি যত বেশি হবে বিদ্যুত উৎপাদন ও তত বেশি হবে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও বায়ুকল দিয়ে সরাসরি পানি তোলা ,পাথর কাটা ,কাঠ কাটা ইত্যাদি কাজে লাগানো যায়। বায়ুকল এভাবে সরাসরি কোন কাজে ব্যবহার হলে তাকে বায়ু কারখানা বা ওইন্ডমিল বলে। যে সব বায়ুকল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সেগুলো বায়ু জেনারেটর,বায়ুকল জেনারেটর,এ্যারোজেনারেটর ইত্যাদি নামে পরিচিত।

বায়ুকল আনুভূমিক বা উল্লম্বভাবে স্থাপন করা যায় তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আনুভূমিক বায়ুকল বেশী ব্যবহৃত হয়। আনুভূমিক বায়ুকল বেশ পুরাতন এবং সবচেয়ে জনপ্রিয়। আনুভূমিক বায়ুকলে জেনারেটর বাতাসের দিকে মুখ করে টাওয়ারের চূড়ায় বসানো থাকে। এ জাতীয় বায়ুকল বায়ুপ্রবাহের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। বায়ু প্রবাহ কমে গেলে এর গতি কমে যায় ,বায়ু প্রবাহ বেড়ে গেলে গতি বেড়ে যায়।

অপরদিকে উল্লম্ববায়ুকলে জেনারেটর আকাশের দিকে মুখ করে বসানো থাকে। এ জাতীয় বায়ুকলে বাতাসের দিকে মুখ করে থাকতে হয়না।

বায়ুকল মুলত পাহাড়ি এলাকা ,সমুদ্র উপকূল অথবা যে সকল এলাকায় বায়ুপ্রবাহ তুলনামূলক বেশী সে সকল এলাকায় স্থাপন করা হয়।

বায়ুকলের ইতিহাস

প্রচলিত আছে যে ইসলামের সোনালী যুগে আধুনিক নগর ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আরব দেশগুলোতে বিদ্যুতের সংকট দেখা যায়। তখন থেকেই কিভাবে মরুভূমির বাতাসকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করা যায় এই বিষয়ে নানা চিন্তাভাবনা এবং গবেষণা শুরু হয়। সেই প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখতে পায় নবম শতাব্দীতে এবং পুর্ব পার্সিয়ায় ইতিহাসে প্রথমবারের মত সফলভাবে বায়ুকল স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ১৩শ শতাব্দীর দিকে এই আবিষ্কার ধীরে ধীরে সমস্ত ইউরোপে ছরিয়ে পড়ে।

বায়ুকলে পাখার সংখ্যা

বায়ুকলের পাখার সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকে না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে বিভিন্ন বায়ুকলে বিভিন্ন সংখ্যায় পাখা বসানো থাকে। সেই পাখা কখনো দুইটি, কখনো তিনটি আবার কখনো বা আরো বেশী ও হতে পারে। সাধারনত এই পাখার সংখ্যা নির্ধারন করা হয়ে থাকে প্রয়োজন অনুসারে। আবার পাখা কেমন প্রশস্ত হবে সেটাও প্রয়োজন এবং ইকোনমিক্যাল দিক বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সাধারণত প্রশস্ত পাখায় বাতাস বেশী লাগে, কিন্ত পাখা বেশি প্রশস্ত হলে সেটা আবার ভারী হয়ে যায়। ফলে পাখার ঘুর্ণন ধীর হয়ে যায়। অপরদিকে পাখার প্রশস্ত কম হলে পাখা হয় ওজনে কম এবং নির্বিঘ্নে ঘুরতে পারে। তাই পাখার সংখ্যা এবং আকার নির্ধারণ এর সময় উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হয়।

বায়ুকল দিয়ে কতভাগ বায়ুশক্তি কাজে লাগানো যায় ?

বায়ুকলের প্রধান কাজ হচ্ছে বায়ুর প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে বায়ু শক্তিকে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত করা। কিন্ত কিছু গবেষনায় দেখা গেছে ,যেভাবেই বায়ুকল স্থাপন করা হোক কখনোই শতভাগ বায়ুশক্তিকে রূপান্তরিত করা যায় না। জার্মান পদার্থবিদ আলবার্ট বেটজ ১৯১৯ সালে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন বায়ুকল বায়ুশক্তির সর্বোচ্চ ৫৯.৩ শতাংশকে রূপান্তর করে কাজে লাগাতে পারে।

বাংলাদেশে বায়ুকল স্থাপনার চিত্র

বাংলাদেশেও বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বায়ুকলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপল সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কয়েকটি বায়ুকল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের মোট দুইটি বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সর্বপ্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র ফেনীর মহূরী নদীর তীর ও সোনাগাজী চরাঞ্চল ঘেষে খোয়াজের লামছি মৌজায় ৬ একর জমির উপর ২০০৫ সালে স্থাপন করা হয়। যার ক্ষমতা .৯ মেগাওয়াট এবং এতে ২২৫ কিলোওয়াটের মোট ৪ টি টারবাইন রয়েছে।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয় ২০০৮ সালে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৫০ টি টারবাইন রয়েছে। অর্থাৎ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট ক্ষমতা ১ মেগাওয়াট।

এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের বেশ কিছু প্রকল্প পরিকল্পনাধীন রয়েছে। যেমন- চট্টগ্রামের আনোয়ারার পারকি বিচ এলাকার ৫০-২০০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, ২২ টি এলাকায় কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই ইত্যাদি।

এছাড়া ডেনমার্কের ভেস্তা কোম্পানি পটুয়াখালীতে ১০০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। যা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদার বিশাল এক অংশ পূরণ করা সম্ভব হবে।

বায়ুশক্তি
5/5 - (12 votes)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button