কেমন হবে কোভিড-১৯ পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতি?
চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার পর থেকে এই আর্টিকেল লেখা পর্যন্ত পৃথিবী ১৭৪ দিন অতিক্রম করেছে। এই ১৭৪ দিনে বিশ্বে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮৯ লক্ষ ছাড়িয়েছে এবং মারা গেছে সাড়ে ৪ লাখেরও বেশি মানুষ। ভাইরাসটির সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়েছেন ৪৭ লক্ষ মানুষ। এই সংখ্যাগুলো নেহায়েতই কম নয়। কোভিড-১৯ই প্রথম বৈশ্বিক মহামারী। এর আগে কোন মহামারী পৃথিবীর এতগুলো অঞ্চলে ছড়িয়ে পরেনি। এই পর্যন্ত এই মহামারী ছড়িয়ে পরেছে ২১০টির বেশি অঞ্চলে।
এবার যদি আমরা একটু বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে আসি তাহলে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রথম রোগী সনাক্ত হয় ৮মার্চ, ২০২০ তারিখে এবং আজ ১০৬ তম দিন।এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষ ৮ হাজার এর বেশি, মৃতের সংখ্যা ১৪২৬ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৪৩,৯৯৩ জন।
এই সংখ্যাগুলো নয় আজকের লেখাটা মূলত কোভিড-১৯ এবং এর পরবর্তী বাংলাদেশ এর অর্থনীতি নিয়ে। কোভিড-১৯ মহামারীতে খুব খারাপ ভাবে বিপর্যস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিও সমানভাবে বিপর্যস্ত। দেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত নিম্নমুখী বিশেষ করে রেমিটেন্স প্রবাহ, রপ্তানি আয়, কলকারখানার উৎপাদন এবং আরো অনেক।
আমরা সকলেই জানি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুইটি স্তম্ভ হচ্ছে রেমিটেন্স আয় এবং রপ্তানি পোষাক। বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এর কারণে সরকারি হিসাব অনুসারেই চীন-ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখের বেশি প্রবাসী দেশে ফিরেছে। যারা বাইরে আছেন তাদের সিংহভাগেরই কাজ বন্ধ। যার প্রভাবে রেমিটেন্স এর প্রবাহ প্রায় ১২% কমেছে।
আবার অন্যদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোষাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র। যেহেতু পৃথিবীতে এখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে তাই ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কমেছে তৈরি পোষাকের চাহিদা। অনেক দেশ আবার সংক্রমনের ভয়ে বাইরে থেকে পণ্য আমদানি করতে চাইছে না। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে এপ্রিলের তিন তারিখ পর্যন্ত তৈরি পোষাক খাতে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্ডার বাতিল হয়েছে। অর্থনীতির প্রধান দুইটি স্তম্ভই যখন এমন ভঙ্গুর অবস্থায় তখন আমরা স্পষ্টতই বলতে পারি দেশের অর্থনীতি খুব একটা ভালো পরিস্থিতে নেই। বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ আশংকা প্রকাশ করেছে যে, অর্থনীতির বিকাশ প্রায় ২০% কমে যেতে পারে।
এখন যদি আমরা একটু দেশের ভেতরে দেখি তাহলে সেখানকার পরিস্থিতিও খুবই নাজুক। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক(ADB) বলছে কোভিড-১৯ প্রভাব খুব খারাপ অবস্থায় পৌছালে বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখের মত কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। কিন্তু এপ্রিলেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রমীক কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন প্রদানের জন্য ৫০০০ কোটি টাকা প্রনোদনা ঘোষণা করার পরেও ছাটাই হয়েছে কর্মী। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার জানান, ‘‘আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে ১৫ হাজারের মতো পোশাক শ্রমিক এরইমধ্যে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন৷’’
করোনা পরিস্থিতে পোষাক কারখানার কাজ ৫৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় জুন থেকে কর্মী ছাটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন বিজিএমই এর সভাপতি রুবানা হক। কিন্তু শ্রমিক নেত্রী নাজমা পারভীন কিছুদিন আগেই জানান ঈদের পর থেকেই কর্মী ছাটাই শুরু হয়েছে এবং প্রায় ৬০-৭০ হাজার কর্মী ছাটাই করা হয়েছে।
এতো গেলো গার্মেন্টস সেক্টর এর কথা। অন্যান্য খাতের অবস্থা আরো খারাপ পরিস্থিতিতে। দীর্ঘদিন বন্ধ ছিলো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং পরিবহন খাত। যদিও এখন সীমিত আকারে সব কিছুই চালু আছে। মানুষের আয় এর পরিমান আশংকাজনকভাবে কমেছে। SANEM এর রিপোর্ট অনুযায়ি যদি পারিবারিক আয় ২৫% কমে যায় তাহলে দারিদ্র্যের হার ৪০.৯ শতাংশ হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ অনুযায়ি দারিদ্র্যের হার ২১.৮% এবং চরম দারিদ্র্যের হার ১১.৩%। যেহেতু মানুষ কর্মসংস্থান হারাচ্ছে সেহেতু নির্দ্বধায় বলা যায় দেশে দারিদ্র্যের হার আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
ABD আরো বলেছে “কোভিড-১৯ মহামারী দেশের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থনীতির ৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে, যা মোট জিডিপির ১%। ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সেবা ক্ষাতে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের বেশি ক্ষতি হতে পারে। যার মধ্যে সবচাইতে বেশি ক্ষতি হবে কৃষি খাতে”।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং উপরিউক্ত তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে করোনা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে খুব বড় অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে যেমনটা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই হবে।
পৃথিবী সর্বশেষ আর্থিক মন্দা দেখেছিল ২০০৮ সালে। কিন্তু তখন বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির সাথে ততটা সংযুক্ত ছিলোনা এখন যতটা আছে। তাই তখন বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশে পরেনি বরং এই থেকে সুবিধাই পেয়েছিলো বাংলদেশ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামিলীগ। আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় আসার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিত্য পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামিলীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন জ্বালানি তেলের দাম কমেছে বিশ্ব বাজারে। যার ফলে খাদ্যপণ্যের দাম কমে যায়। যেটার সুবিধা নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু ২০০৮ সালের মত এখন সুবিধা নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রায় কোমড় ভেঙ্গে পড়ে যাওয়া অর্থনীতিকে দাড় করানো চাট্টিখানি কথা নয়।
এরই মধ্যে সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছে। যার পরিমানও ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। গেল অর্থবছরে যার পরিমান ছিলো ৫ লক্ষ ২৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির এমন খারাপ অবস্থায় এত বিশাল পরিমানে বাজেট সরকার কি ভেবে ঘোষণা করেছে তা আমার জানা নেই। এই বাজেট কিভাবে বাস্তবায়িত হবে সেটা নিয়েও আমি দ্বিধান্বিত।
কোভিড-১৯ মহামারী কতদিন থাকবে তা আমরা জানিনা। ভ্যাকসিন আদৌ আবিষ্কৃত হবে কিনা সেটাও জানা নেই। এমনও হতে পারে এই মহামারীকে সাথে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন কোন নিশ্চিত সমাধান নয়। তবে আমরা আশা করতে পারি এই মহামারী বেশিদিন থাকবে না। সূর্য আবারো নতুনভাবে উঠবে। যেই সূর্যের আলোতে থাকবে না কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসে সংক্রমিত হবার ভয়। সেই নতুন সূর্যের আলোতে আমাদের আবার নতুন উদ্যমে শুরু করতে হবে। সরকার ও সাধারণ জনগন হাতে-হাত রেখে একসাথে সকলে মিলে আবার গড়ে তুলব আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতি। মহান ঈশ্বরের কাছে সেই কামনা রেখে শেষ করছি আমার এই লেখা।
সবাই ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। আপনি নিরাপদে থাকলেই নিরাপদে থাকবে দেশ।
লেখায় কোন প্রকার ভুল-ত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার এবং কমেন্ট করে জানানোর অনুরোধ করছি।