অর্থনীতি

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট কেমন হলো?_বাজেট ভাবনায়

বর্তমান বিশ্বের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বাদ যায়নি আমাদের এই ছোট দেশ বাংলাদেশ। গত মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ এই করোনা ভাইরাস মানে কভিড-১৯। এই আপদকালীন সময়েও বাংলাদেশ সরকার ঠিক সময়ে বাজেট প্রেস করেছে যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এই সময়ে বাজেট ঠিক কতটুকু আমাদের দেশের জন্য ফলপ্রসু হবে তা চিন্তার বিষয়। প্রাথমিকভাবে বলা যেতে পারে যে সরকার বর্তমান সময়কে মাথায় রেখে চেষ্টা করেছে চিহ্নিত খাতসমূহকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট বরাদ্দ দিতে। তবে আমি বলব সরকার গতানুগতিক চিন্তা থেকে ঠিক বের হতে পারেনি। কেননা, বর্তমানে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের ঝুঁকি বেড়েছে, দিন দিন মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছে। এমন সময় আমরা সবাই আশাহত হচ্ছি। তাই এবারের বাজেটে অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো স্বাস্থ্য। এছাড়াও এই মহামারির কারনে আমাদের দেশের অর্থনীতি থমকে গেছে, বিগত ১০-১৫ বছর বাংলাদেশ যে গ্লোবালাইজেশনের দিকে আগাচ্ছিল, তার সবকিছূই থমকে গেছে।

এবছরের বাজেটের অনেকগুলো খাতকে আমাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত তবে আমি এই মহামারির দিনে স্বাস্থ্যখাতকে এগিয়ে রাখব। এমন সময় আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা কারন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে কেবল আমরা এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারব। শুধু আসন্ন বছরটি নয়, আরও দু-তিন বছরের বাজেট কাঠামোতে কেন্দ্রীয় বিবেচনায় রাখতে হবে স্বাস্থ্যখাতকে, যাতে এই খাতে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়। তবে হ্যা অনেকে বলতে পারে যে আমরা একনেকের মিটিং এ স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ অনুমোদন দিয়েছি। কিন্তু শুধু বরাদ্দ নয় এর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যে বাজেট হচ্ছে সেটা কি সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে কিনা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

আমাদের বর্তমান সময়ে বাজেট নিয়ে যে বির্তক হচ্ছে তা হলো ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে কি হবে না তা নিয়ে। আসলে আমাদের এই সময়ে এই প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবার সময় না। কারণ এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আমাদের ভাবতে হবে সুরক্ষা নিয়ে। ভাবতে হবে যে আমরা আসলে বেঁচে থাকব কিনা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্তদের আয় প্রায় বন্ধ, প্রবাসী শ্রমিকরা ফিরছে, রপ্তানি কমছে, শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে। এমনকি দারিদ্র বাড়ছে। তাই এমন সময়ে আমাদের প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবনা নয় টিকে থাকার জন্য ভাবতে হবে।

যথেষ্ট সর্তকতা অবলম্বন করেই এবারের বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এবছর স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি যেটা কিনা মোট বাজেটের ৫.১ শতাংশ। এছাড়াও ১০ হাজার কোটি টাকার একটি করোনা তহবিল করা হয়েছে, যেটা কিনা স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে সরকার চাইলে বাজেট ঘাটকি বাড়িয়ে এই খাতে আরও বরাদ্দ দেয়া যেতো।

সামাজিক সুরক্ষায় বাড়তি বরাদ্দ ইতিবাচক বলে আমার মনে হচ্ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এসএসএনপি সুবিধাভোগি বাড়ানো হয়েছে ২০ শতাংশ ( সাধারণত ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়।) যেখানে বাড়তি বরাদ্দ ১,৬৩৩ কোটি টাকা। তাই মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় এক কোটিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দারিদ্র্য হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৩ শতাংশের বেশি হতে পারে। তাই এইখাতে বরাদ্দ আরও বাড়লে দারিদ্র্য নিরসনে এক দশকের অর্জন আরও সুরক্ষিত হতো। এছাড়াও নতুন সঙ্কটে পড়া বিপন্ন মানুষের জন্য উদ্ধাবনী কর্মসূচি নেয়া যেতো। বিশেষ করে নগর দারিদ্র্য, চর-হাওর-পাহাড়ী এলাকার মতো দুর্গম অঞ্চলের নাগরিকদের জন্য বাড়তি বরাদ্দ কিংবা নতুন কর্মসূচি নেয়া যেতো। এছাড়াও সরকার আরও উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করেছে এইবার করোনাকালে যেমন: ৫০ লক্ষ মানুষকে ২,৫০০ টাকা করে এবং ১০ টাকা কেজি চাল। একটা কথা আমি শুনেছি যে, সরকার বলেছে যে সকল প্রতিবন্ধীদের যুক্ত করতে হবে এই সোস্যাল সেফটিনেস এর আওতায়। এমনটা হলে তা সত্যিই প্রশংসনীয় হবে।

কৃষি হতে পারে মন্দা মোকাবিলার রক্ষা কবচ । এবছর কৃষি বরাদ্দ বাজেটের ৪ শতাংশ কম থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৩ শতাংশে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখবে পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তায় সহায়ক হবে বলে আমি মনে করছি। এছাড়াও কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখা, কৃষকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কৃষি পণ্য সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে এই দুর্দিনেও সুফল পাওয়া যাবে। এই জন্য কৃষিখাতে ভর্তুতি বাড়ানো যেতো। তাই আর্থিক এবং মুদ্রানীতি ঢেলে সাজাতে হবে।

এবারের শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ। যা কিনা মোট বাজেটের ১৫.১ শতাংশ। তবে সকল স্তরের শিক্ষায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও মন্দার প্রভাব পড়েছে, বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তাই দরকার উদ্ধাবনী প্রকল্প। বিশেষ করে দুরশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ডিজিটাইজেশনে চাই আরো মনযোগ।

শিক্ষাব্যবস্থার কথা যদি চিন্তা করি। বিশেষ করে রিমোট লার্নিং এর কথা। অর্থাৎ মোবাইল বেইস শিক্ষায়। অথচ এবছরের বাজেটে ওয়াইফাই এর উপর নতুন করে ট্যাক্স বসিয়েছেন। যখন একটি সামগ্রিক ব্যবহার বাড়ে তখন অর্থাৎ সহজ একটি হিসাব দেই ব্যবহার যদি বাড়ে যদি একজিসটিং ট্যাক্স থাকে তা হলে অটোমেটিক আয় বেড়ে যাবে। আগে যে ছাত্রটি দিনে ২/৩ ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করত, সে ছাত্রটি এখন প্রতিদিন গড়ে ৫/৭ ঘণ্টা ব্যবহার করছে। তার মানে আগের থেকে অনেকগুণ ব্যবহার বেড়েছে। এক্ষেত্রেও সরকার চিন্তা করছেন গতানুগতিক। সরকারের কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে যে এবছর ইন্টারনেট বা মোবাইলের উপর যে কর আরোপ করা হয়েছে তা উঠিয়ে নেয়া হোক। কেননা, এই মহামারির সময়ে থমকে আছে আমাদের দেশের এই শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল করতে হলে, সরকারকে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম এর দিকে আলোকপাত করা উচিত। আর অনলাইল এই কার্যক্রম চালু করতে হলে সবার জন্য ইন্টারনেট সুবিধা শিথিল করা একান্ত দরকার।

আমি মনে করি  এই মুহূর্তে এবছরের বাজেট থেকে আয়ের চিন্তা না করে ভাবতে হবে কোথায় কোথায় ব্যয় করলে আমাদের দেশের জন্য মঙ্গল হবে কারণ এই সঙ্কটময় সময়ে আমাদের বড় চ্যালেন্জ হলো বেঁচে থাকা। আয় হবে না বলে আমি ব্যয় করবো না এই ঘটনা ঘটানোর কোন সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নাই বলে আমি মনে করছি।

সরকার যদি ভাবে যে শুধু মাত্র সোস্যাল সেফটিনেস দ্বারা সবকিছু সম্ভব হবে। তাহলে বলব এটা সম্ভবপর হবে না কারন সোস্যাল সেফটিনেস এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র গরিব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য। আপনার ভাবতে হবে যে বর্তমান সময়ে মধ্যবিত্ত যারা আছে তাদের কথা কারণ তারা যদি কাজ না করতে পারে তবে তারা কিন্তু গরিব হয়ে যাবে। তাদের জন্য আপনার বিকল্প চিন্তা করতে হবে। যাতে তারা তাদের অবস্থান ঠিক ভাবে ধরে রাখতে পারে। অর্থাৎ সোস্যাল সেফটিনেস এর পাশাপাশি আপনি বিকল্প চিন্তা করতে পারেন এতে দেশের এবং জনগণের মঙ্গল হবে। এবছরের বাজেটে আমাদের উচিত ছিল গতানুগতিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমান সময়ের সাথে সমন্বয় করে বাজেট দেয়া কারন এই সময়ে আমাদের শুধুমাত্র অগ্রাধিকার খাত সমূহকে মাথায় রেখে বাজেট দিলে আমার মনে হয় ভাল হতো।

সবশেষে বলতে চাই, স্বাস্থ্য খাত এবং শিক্ষাখাত কে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট বরাদ্দ দেয়া যদিও বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে কিন্তু তা যথাযথ ভাবে বাস্তবায়নের কোন নতুন কৌশল দেখছি না। তাই বরাদ্দ দেয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়নের কৌশলও তুলে ধরতে হবে।

Rate this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button