শিক্ষা

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বর্তমানে বাংলাদেশের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা রকমের দুর্যোগে কবলিত হচ্ছে বাংলার হাজারো মানুষ। একারনে স্কুল-কলেজের বিভিন্ন পরীক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা – বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা। তাই আপনাদের সুবিধার্থে রইল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে রচনা।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা

ভূমিকা: বাংলাদেশ হল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবন দেশ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এদেশের মানুষের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশ হয়ে থাকে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিঃ প্রাকৃতিকভাবে যেসব দুর্যোগ হয়ে থাকে সেটাই হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের সাধারণ জীবনধারাকে ব্যাহত করে। মানুষের সম্পদ ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে, দুর্যোগে আক্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণঃ পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর বহু দেশে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হয়তো প্রাকৃতিক কারণে হতে পারে। আর বেশিরভাগ পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে শিল্প উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য। তাদের অতি বিলাসী জীবনের জন্য ও যন্ত্র নির্ভরশীলতার জন্য পৃথিবীতে গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। দেশের কলকারখানা ও গাড়ি থেকে অতিমাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে এবং তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এতে সমুদ্র নদীর কম্পন বাড়ার ফলে নদী ও সমুদ্রের উপকূলের ভাঙ্গনের হাড় বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দরিদ্র দেশগুলো।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছরই অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বছর বছর দুর্যোগের পরিমাণ আগের থেকে অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে।এতে মানুষ দিন দিন আরো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে । বাংলাদেশে বিভিন্ন রকমের দুর্যোগ হয়ে থাকে যেমন -বন্যা, সাইক্লোন জলোচ্ছ্বাস, জ্বর-ঝঞ্ঝা,খরা, নদী ভাঙ্গন, ভূমিকম্প ও লবণাক্ততা ইত্যাদি।

বন্যাঃ বর্ষার ভয়ংকর রূপ হল বন্যা। বাংলাদেশে প্রতিবছর এখন বন্যা হয়। বন্যার জন্য মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বন্যা বিগত চার দশক ধরে বাংলাদেশের একটি বার্ষিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এতে অসংখ্য মানুষ ও গৃহপালিত পশু ও প্রাণ হারায়, ঘরবাড়ি কৃষি ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়। ব্যাপক প্রাণহানি সহ প্রচুর সম্পদের ক্ষতি হয়। বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয় ১৯৯৮ সালে। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে দেশে বহু ক্ষেতের ফসল, মূল্যবান সম্পদ ও ঘরবাড়ির মারাত্মক ক্ষতি হয়। আর বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হলো ২০০৪ সালের বন্যা। এ বন্যায় দেশের সব ক্ষয়ক্ষতের পরিমাণ প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।

সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসঃ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস। প্রতিবছরই এই দুর্যোগ বাংলাদেশে কম বেশি আঘাত হানে। বাংলাদেশের সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ১৯৭০, ১৯৯১ ও ২০০৭ সালে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায় স্মরণকালের সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস যা ছিল খুবই ভয়াবহ। এই ধরনের সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসে ১৯৭০ সালে প্রায় ৫ লাখ, ১৯৯১ সালের প্রায় দেড় লাখ এবং ২০০৭ সালের প্রায় লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে। লাখ লাখ নারী পুরুষ আশ্রহীন হয়ে পড়ে। সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ফলে মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা পতিত হয়।

ঝড়-ঝঞ্ঝাঃ বাংলাদেশের আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে হচ্ছে ঝড়ঝঞ্জা। বাংলাদেশের প্রতিবছরই কালবৈশাখী ঝড় ও বিভিন্ন সময়ের ঝড় মানুষকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন প্রায় সারা বছরেই ঝড়-ঝঞ্ঝা হয়ে থাকে। কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে অনেক মানুষ ও গৃহপালিত পশু মারা যায় এবং ফসলী ক্ষেত অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

খরাঃ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রকৃতির জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাঝে মাঝে অনাবৃষ্টি বা খরার মত মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পতিত হয়। মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে যায় খরার প্রচণ্ড তাপে। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে খরার কারণে অনেক ফসলাদিসহ জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। খরার কারণে বিভিন্ন রোগ শোক ও খাদ্যের অভাব দেখা দেয় এদেশে এবং মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

নদী ভাঙ্গনঃ বাংলাদেশ হলো নদীমাতৃক দেশ। এদেশের বুক চিরে বয়ে গেছে ছোট বড় হাজারো নদী। নদীর ধর্মই হলো এবার ভেঙে ওপার গড়া। বাংলাদেশের আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে হলো নদী ভাঙ্গন। এদেশের প্রচুর সম্পদ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় প্রতিবছরই। এই দুর্যোগের কারণে দেশের বহু লোককে তাদের ঘর বাড়ি, ধনসম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব জীবনযাপন করতে হয়। নদীর ভাঙ্গনের জন্য দেশের উন্নতির বদলে এখন অবনতি হচ্ছে প্রতিবছর।

ভূমিকম্পঃ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আরো এক ভয়াবহ রূপ হলো ভূমিকম্প। এদেশে মাঝে মাঝে ছোট বড় ভূমিকম্প বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানে। ভূমিকম্পের মাত্রা বেশি হলে তাতে অনেক ক্ষয়ক্ষ ক্ষতি হয়ে থাকে। এতে বাড়ি ঘর ও রাস্তাঘাট ভেঙ্গে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয় এবং জানমালের ও অনেক ক্ষয়ক্ষত হয়ে থাকে। ভূতাত্ত্বিকরা বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল কে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার আওতাভুক্ত। এই এলাকার মানুষগুলোকে সবসময় সচেতন ভাবে থাকতে হয়।

লবণাক্ততাঃ এদেশের সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলের এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল লবণাক্ততা। উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্রভাবে লবণাক্ত থাকে। লবণাক্ততার কারণে কোন ফসল উৎপাদিত হয় না। ফসল উৎপাদিত না হওয়ার কারণে ওই উপকূলে বসবাসকারী মানুষগুলোর অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে।

দুর্যোগ ও তার প্রতিকারঃ মানুষের জন্য যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ-ই হুমকি স্বরূপ। আমাদের সবার একান্ত কর্তব্য হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা। বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের ব্যাপকভাবে বনায়ন করা উচিত। সারাবিশ্বের প্রতিটি দেশের ২৫ শতাংশ স্থলভাগের বনায়ন করা উচিত। শিল্প উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন কলকারখানার উত্তপ্ত কালো ধোয়া নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা। এবং দেশের জনগণের মধ্যে পূর্ব প্রস্তুত মূলক সচেতনতা সৃষ্টি করা। জাতীয়ভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্ম পদ্ধতির ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে জাতীয় স্থানীয় পর্যায়ে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা। দুর্যোগ মোকাবেলায় যারা নিয়োজিত থাকবে তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সরকারি বেসরকারি উভয় পর্যায়ে দুর্যোগ মোকাবেলা যৌথ কার্যক্রম গ্রহণ করা। সবাই সচেতন থাকলে দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার উপায়ঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য নিম্নোক্ত উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে :

১. উন্নয়ন বান্ধব কার্বন কনটেন্ট বানাতে হবে।
২. গ্রীন হাউজ কমাতে হলে জ্বালানি কমাতে হবে।
৩. কলকারখানার বর্জ্য ও শহরের মলমূত্র এবং আবর্জনা সরাসরি নদীতে না ফেলে প্রতিশোধন করে নদীতে ফেলতে হবে ।
৪. পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে এবং গাছ লাগিয়ে বনাঞ্চল তৈরি করতে হবে।
৫. পাহাড়, জলাভূমি, কৃষিজমি ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান গুলো ধ্বংস করে বসতবাড়ি ও কলকারখানা নির্মাণ করা যাবে না।
৬. দুর্যোগ হওয়ার পূর্বে জনগণকে সতর্ক করতে হবে।
৭. কোন দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা দিলে দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হবে।
৮. দুর্যোগ মোকাবেলায় নিয়োজিত কর্মীদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সব কিছু সম্পাদন করার জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার থেকে সাহায্য নিতে হবে।
৯. যে নদী মরে গেছে বা যাচ্ছে সেগুলোকে পরিষ্কার করে নাব্যতা বাড়াতে হবে।
১০. পৃথিবীর শিল্প উন্নত দেশগুলো যদি সমঝোতার মাধ্যমে অন্তত ১০-১৫ বছর গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে রাখতে পারে তাহলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হতে পারে।

উপসংহারঃ পৃথিবীর যে কোন দেশের মানুষের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ অভিশাপ স্বরূপ। এটি জনজীবনকে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখ দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের মতো একটি সমতল ভূমির দেশের অবিরত দুর্যোগ সংঘটিত হয়ে এদেশের জাতীয় অর্থনীতিকে নড়বড় করে দিচ্ছে এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাধা হয়ে পড়ছে। দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে মানুষের কোন হাত না থাকলেও দেশের সরকার ও সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর মোকাবেলা করার প্রয়াস চালাতে হবে।

4.6/5 - (37 votes)

Sajjad Hossain

When I'm not immersed in the world of content creation, you'll find me actively engaging with the online community. I believe in the power of collaboration and learning from shared experiences. Let's connect on [social media platform] for real-time updates, discussions, and a glimpse into the exciting journey of online earning.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button