শিক্ষা

এপিকালচার কি

এপিকালচার হলো মৌমাছি পালন। মানুষ যখন কৃত্তিমভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন করে এবং মধু ও অন্যান্য উপাদান যেমন মোম, পরাগরেণু, রাজকীয় জেলী ইত্যাদি তৈরি করে থাকে তখন তাকে এপিকালচার বলে। যে মৌমাছি পালন করে থাকে তাকে বলে মৌমাছি পালন কারী এবং যেখানে মৌমাছি পালন করা হয় তাকে বলে মৌমাছি পালনকেন্দ্র।

মৌমাছির সামাজিক সংগঠন

মৌমাছি সামাজিক পতঙ্গ। এর একত্রে কলোনি আকারে বাস করে। এদের কাজ বিভিন্ন হয়ে থাকে। এক এক মৌমাছির কাজ এক এক রকম। মৌমাছির বাসাকে মৌচাক বলে।

সাধারনত একটি কলোনিতে তিন ধরনের মৌমাছি থাকে। রাণী মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি ও কর্মী মৌমাছি। একটি কলোনিতে সাধারনত একটি রাণী মৌমাছিই থাকে। অন্য কোন নতুন রাণী মৌমাছি জন্ম নিতে চাইলে পুরাতন রাণী মৌমাছি নতুন রাণীকে হুল ফুটিয়ে মেরে ফেলে। এক একটা কলোনিতে ১০০০০-৩০০০০ কর্মী মৌমাছি থাকে এবং কয়েকশত পুরুষ মৌমাছি থাকে।

প্রতিটিা কলোনিতে একটি রাণী মৌমাছি থাকবে। নিষিক্ত ডিম থেকে রাণী মৌমাছি জন্ম নিয়ে থাকে। এই রাণী মৌমাছিই একমাত্র প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে থাকে। রাণী মৌমাছি তৈরির জন্য মৌমাছির একটি লার্ভাকে রাজকীয় জেলী খাওয়ানো হয়ে থাকে। যে মৌমাছি রাজকীয় জেলী খেয়ে থাকে সে মৌমাছিই রাণী মৌমাছি হয়। কলোনী বড় হয়ে গেলে রাণী মৌমাছি কিছু সংখ্যক কর্মী মৌমাছি নিয়ে অন্যত্র চলে যায় এবং নতুন কলোনীতে তখন আরেকটি লার্ভাকে রাজকীয় জেলী খাওয়ানো হয়।

তখন সেখানে সেই মৌমাছি রাণী মৌমাছি রূপে প্রকাশ পায়। রাণী মৌমাছি সাধারণত অলস হয়ে থাকে। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানো ছাড়া এদের আর কোন কাজ থাকে না।

কলোনীতে পুরুষ মৌমাছি থাকে। পুরুষ মৌমাছি সাধারনত অনিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম নেয়। এরা আলাদা একটা প্রকোষ্ঠে বাস করে। খাদ্যের জন্য এর সম্পূর্ণভাবে কর্মী মৌমাছির উপর নির্ভর করে থাকে।

কর্মী মৌমাছি ও নিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম নেয় তবে এর অনুর্বর হয়ে থাকে। কলোনিতে এদের আকার সবচেয়ে ছোট হয়ে থাকে এবং এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি থাকে। এদের কাজ হচ্ছে মধু সংগ্রহ করা, ছোট ছোট মৌমাছিদের দেখাশুনা করা, মোম পরিষ্কার করা, মৌচাকের নিরাপত্তা রক্ষা করা ও মৌচাকের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। এরা এদের নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে বাস করে এবং ডিম থেকে পরিণত বয়স্ক হতে ২১ দিন সময় লাগে।

এরা সাধারনত ছয় সপ্তাহ বেঁচে থাকে। একটি কর্মী মৌমাছি তার জীবনকালে অনেক ধরনের কাজ করে থাকে। জীবনকালের প্রথম অর্ধেক সময় তার কাটে রাণী মৌমাছির সেবা করে। রাণী মৌমাছির জন্য রাজকীয় জেলী তৈরি করা, রাণীর জন্য বিশেষ ধরনের রুটি তৈরি করা যা মৌ রুটি নামে পরিচিত, রাণীকে খাবার খাওয়ানে, পুরুষ মৌমাছির খেয়াল রাখা, মোম নি:সরণ করা, মৌচাক পরিষ্কার রাখা ও এর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি কাজ করে। তারপরের সময়ে সে মধু সংগ্রহের কাজ করে থাকে।

মৌচাক থেকে মধু দুই ভাবে সংগ্রহ করা যায়।

১. প্রাকৃতিক ভাবে বন জঙ্গল থেকে
২. কৃত্তিম পদ্ধতিতে চাষ করে।

কৃত্তিম পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ করার জন্য দুই প্রজাতির মৌমাছি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। Apis cerena or Apis mellifera এই দুই প্রজাতির মৌমাছি চাষ করা হয়ে থাকে। মৌমাছি চাষ এর দুইটি পদ্ধতি রয়েছে।

১. প্রাচীন পদ্ধতি
২. আধুনিক পদ্ধতি

প্রাচীন পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে সাধারনত একটি ঘের তৈরি করে দেয়া হয় মৌমাছির জন্য। যেহেতু এতে কোন অভ্যন্তরীণ গঠন থাকতনা তাই মৌমাছিরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে এখানে চাক তৈরি করত। এটির সমস্যা হলো এটা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বহন করা যেত না। চাক স্থানান্তর করার জন্য এটি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করতে হতো। তাই এই চাক তৈরি করা হতো দুই ভাবে।

স্থানান্তরযোগ্য- এটি তৈরি করা হতো কোন কাঠের বাক্স বা কোন পাত্রে। মৌমাছিরা বন জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ করে এই পাত্রে সংরক্ষণ করত।
অস্থানান্তরযোগ্য- এর জন্য মৌমাছিদের একটি প্রাকৃতিক স্থান দেয়া হতো।

প্রাচীন পদ্ধতির অসুবিধা

১. এই পদ্ধতিতে মৌমাছির প্রজাতি নির্ধারণ করা সমস্যা হয়।
২. মধু সংগ্রহ করার সময় ধুয়া দেয়ার কারণে অনেক মৌমাছি মারা যায়। এতে মৌমাছির পপুলেশনে সমস্যা হয়।
৩. প্রাচীন পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে মধু আলাদা করার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হয়।

আধুনিক পদ্ধতি

আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালনে সুবিধা অনেক। এই পদ্ধতিতে সাধারনত একটি বাক্স ব্যবহৃত হয় যা ছয়টি অংশে বিভক্ত থাকে।
১. স্ট্যান্ড– এটি হচ্ছে পুরো মৌচাকের ধারক। এটি প্রকোষ্ঠগুলোকে সঠিকভাবে ধরে রাখে। এছাড়া এতে রয়েছে ড্রেনেজ সিস্টেম যা বৃষ্টির পানি জমা থেকে রক্ষা করে থাকে।

২. নিচের তক্তা– তক্তা এর নিচে স্ট্যান্ড থাকে। এতে একটি প্রবেশ পথ ও একটি নির্গমন পথ থাকে যা দিয়ে মৌমাছি প্রবেশ করে ও বের হয়।

৩. প্রজনন প্রকোষ্ঠ– মৌচাকের মধ্যে এই অংশটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । এতে ৮-১০ টি ফ্রেম থাকে যার মাধ্যমে খুব সহজেই কর্মী মৌমাছি যাতায়াত করতে পারে। এখানে মোমের তৈরি কিছু আবরণী দেয়া থাকে যা ভূমির সমতলে থাকে। এই অংশটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানেই ভ্রূণ লালনপালন হয়ে থাকে। এছাড়া ও এখানে ভ্রূণের জন্য পরাগরেণু সংগ্রহ , জমা ও মধু জমা করা হয়।

৪. মধুকক্ষ – প্রজনন প্রকোষ্ঠ এর উপর থাকে মধুকক্ষ। এটি যেকোন আকার আকৃতির হতে পারে। সাধারনত এর আকার নির্ভর মৌসুমের উপর এবং স্থান বিশেষ। এখানে মধু ও মোম তৈরি হয়ে থাকে।

৫. ভিতরের আবরণ– এটি একটি কাঠের তৈরি পাতলা তক্তা জাতীয় যেটি দ্বারা মধুকক্ষ ঢাকা থাকে। এতে প্রচুর ছিদ্র থাকে যাতে মধুকক্ষের ভিতর পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে।

৬. উপরের আস্তরণ– মধু বাক্সকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই আবরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি সমান হয় ও একটু ঢালু হয়ে থাকে যাতে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ে যায়।

মৌমাছি চাষ করার সময় এই মৌ বক্স ছাড়াও আরো কিছু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়ে থাকে। যেমন

গ্লাভস- মৌচাক পরিদর্শন করার সময় এটি হাতে পরতে হয়।

পোশাক- মৌমাছি পালনকারীদের আলাদা পোশাক পরতে হয় যাতে মৌমাছি হুল ফোটালে তা গায়ে না লাগে।

ধোঁয়া দেয়ার যন্ত্র- মধু সংগ্রহ করার সময় মৌমাছি তাড়ানোর জন্য এই ধোঁয়া দেয়ার যন্ত্র দরকার হয়।
এছাড়াও মোম পরিষ্কার করার যন্ত্র, ছুড়ি, ব্রাশ ইত্যাদি প্রয়োজন হয়ে থাকে।

মৌমাছি চাষ করার জন্য উপযুক্ত স্থান বাছাই

স্থান বাছাই করার সময় এমন স্থান বাছাই করতে হবে যেখানে প্রচুর পরিমানে ফুল আছে। যেখান থেকে মৌমাছি প্রচুর পরিমানে নেক্টার ও পোলেন সংগ্রহ করতে পারবে। কারণ ভ্রূণ ও পরিণত মৌমাছি উভয়েরই খাদ্য এই নেক্টার ও পোলেন। স্থানটি যেন মৌমাছির জন্য অভয়ারণ্য হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেন অন্য কোন পোকামাকড় মৌমাছিকে আক্রমন করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মৌচাক তৈরির স্থানটি দূষণমুক্ত স্থানে হতে হবে এবং জনমানব এর কম যাতায়াতযোগ্য হতে হবে।

মধু সংগ্রহ

আধুনিক পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহের জন্য আলাদা প্রকোষ্ঠ থাকায় সেখানেই সব মধু জমা হয় তাই মধু সংগ্রহ করার সময় প্রজনন প্রকোষ্ঠের কোন ক্ষতি হয় না। এছাড়া খুব অল্প পরিশ্রমে এবং অল্প ধোঁয়া প্রয়োগেই মধু সংগ্রহ করা যায়।

রোগ দমন

মৌমাছি পালনে অবশ্যই রোগ বালাই এর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মৌমাছি যেন রোগাক্রান্ত না হয়ে পড়ে। মৌবাক্স সবসময় শুকনা রাখতে হবে নয়তো মোমপোকা নামক এক ধরনের পোকার আক্রমন হয়ে থাকে। এ পোকা আক্রমন করলে প্যারাডাইক্লোরো বেনজিন নামক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া অ্যাকারাইন নামক এক ধরনের রোগ আক্রমন করে থাকে। এটি সাধারনত প্রাপ্ত বয়স্ক মৌমাছির হয়ে থাকে। এজন্য মিথাইল স্যালিসাইলেট ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

মৌমাছি পালনে লাভ ক্ষতি

সাধারণত একবার ঠিকভাবে মৌ বাক্স স্থাপন করার পর তারপরের ১০-১২ বছর এই বাক্স দিয়েই চলে। দিন দিন মধুর চাহিদা বাড়ছে তাই এই ব্যবসা অনেক লাভজনক

5/5 - (14 votes)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button