গল্প

গল্পঃ তনু আমার বোন

আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি আর টুকটাক লেখালেখি করি। মাঝে মধ্যে কয়েকটা স্বনামধন্য পত্রিকায় আমার লেখা কলাম ছাপা হয়। গত বছর একটা বইও বের করেছি আমি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ দুঃখ আর ভালোবাসার গল্প নিয়ে একটা উপন্যাস।উপন্যাসের নাম দিয়েছি ‘অপরাহ্ন’। উপন্যাসটা মোটামুটি ভালোই প্রশংসা কুড়িয়েছে।কিন্তু যতটা আশা করেছিলাম ততটা হয়নি। তবে উপন্যাসটা আমাকে লেখক হিসেবে একটু পরিচিতি দিয়েছে। আমি মাঝে মধ্যে ছোট গল্প লিখে সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করি। আমার ফলোয়ার এতো বেশি না। তবে ফ্রেন্ডলিস্টে অনেক চেনা অচেনা মানুষ আছে। প্রতিদিন নতুন নতুন ফ্রেন্ডরিকুয়েস্ট আর মেসেজ আসে।আমার লেখার প্রশংসা করে। রেস্টুরেন্টে একসাথে খাবার খাওয়ার অফার দেয়।

আমি অবসর থাকলে কাউকেই না করি না। সময় দেই। মাঝে মধ্যে আমিই নিজে থেকে ডিনার করি গিয়ে। তবে একজনের সাথে দুইবারের বেশি রেস্টুরেন্টে যাওয়া হয় না।তারপরও দুইটা মেয়ের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটে গেছে। সব ক্ষেত্রেই কিছু ব্যতিক্রম থাকে।আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে।

এর মধ্যে একজন হলো তনু। বেশ চতুর মেয়ে। কথা বলে একটু বেশি। তার বাবার টাকা পয়সা আছে ভালোই। সে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। সে আগে থেকে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে থাকে না। সে আমার বাসার সামনে রিকশা নিয়ে আসে, তারপর দুজন মিলে রেস্টুরেন্টে যাই। দুজনের মধ্যে অনেক কথা হয়। সে অনেক কথা বলতে পারে। আমিও যথেষ্ট কথা বলি। তারপরও সে বলে, ‘এতো চুপ করে থাকেন কেন? কিছু বলতে পারেন না?লেখার সময় এতো কথা আসে কোথা থেকে’
হাসে তনু।তার মুক্তা ঝরানো হাসিটা আমার ভালো লাগে। আমি তনুকে সেটা বলি। শুনে সে আবার হাসে। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। তনু একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসে। ছেলেটা তাকে বিয়ে করবে বলেছে। তনুর কাছ থেকে কয়েকমাস সময় চেয়েছে। এ কয়েক মাস তনুকে সে বেশি টাইম দিতে পারবে না। তনু হয়তো এজন্যই আমার সাথে সময় কাটায়। আমিও অবসর সময় থাকলে তাকে না করি না। কারণ তনুর সাথে সময় কাটাতে আমারও ভালো লাগে।তবে তার মনের মানুষ আছে বিধায় তার হাসি, প্রাণচাঞ্চল্যতা আর আমার সাথে সময় কাটাবার যে তার প্রয়াস সেগুলো আমার মন কাড়লেও তার মনের সাথে আমি দূরত্ব রেখে চলি।

অপর যে মেয়েটির সাথে আমার দুয়ের অধিকবার রেস্টুরেন্টে যাওয়া হয়েছে তার নাম বীনা।দেখতে ফর্সা না হলেও তার চেহেরায় মাধুর্যতা আছে। তার চোখের দিকে তাকালে যে কেউ মায়ায় পড়ে যাবে। বীনাকে প্রথমবার দেখার পর তনুর মতো চতুর মনে হলেও পরে বুঝতে পারলাম, সে সহজ সরল। তার সাথে দ্বিতীয়বার রেস্টুরেন্টে যাওয়ার দিন সে আমাকে হঠাৎ বললো, ‘আমার জীবনের কিছু ঘটনা আছে। সেগুলো আপনাকে লিখতে হবে’
আমি প্রথমে রাজি হলাম না। বললাম, ‘যার ঘটনা সে নিজে লিখলে উত্তম হয়’
প্রত্যুত্তরে সে বললো, ‘আমি লিখতে পারলে কি আর আপনাকে বলতাম!’
আমি ভাবলাম কিছুক্ষণ। গল্প লিখতে হলে একটা প্লট দরকার হয়। কয়েকদিন ধরে আমি প্লট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বীনার জীবনের কাহিনীটাকে প্লট হিসেবে নিলে আগামী দুই তিন সপ্তাহ আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না। তাই সাত পাঁচ ভেবে আমি রাজি হয়ে গেলাম।ভাবটা এমন করলাম যে তার কাহিনীটা নিয়ে লিখতে ইচ্ছে ছিলো না, সে অনুরোধ করছে বলেই লিখছি।
‘ঠিক আছে আমি লিখবো’
বীনাকে দেখে মনে হলো সে খুশি হয়েছে। খেতে খেতে অনেক কিছু বললো সে। তার প্রেমিকই প্রথম তার সান্নিধ্য কামনা করেছিলো। মোবাইলে দুজনের মধ্যে অনেক কথা হতো। এক পর্যায়ে তার প্রেমিক লিমন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। সে প্রস্তাবে বীনা আহ্লাদে আটখানা হয়েছিলো। কিন্তু সেদিন কি বীনা জানতো এই প্রেমই তার জীবনে দুঃখ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে!! বহু ছেলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া বীনা লিমনের প্রতি এতোটাই অনুরত হয়ে গিয়েছিলো যে সে তার দেহ বিলিয়ে দিতেও পিছপা হয়নি। শুধু দেহ নয়,আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমেও সে তার প্রেমিকের মন জয় করতে চেয়েছিল।
বীনা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘বাকিটা আরেকদিন বলবো’
বীনার কণ্ঠাটা কেমন ভারী হয়ে আসছিলো।
আমি ‘আচ্ছা’ বলে রেস্টুরেন্ট ত্যাগ করলাম।
এরপর আরো বেশ কয়েকদিন আমি বীনার সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়েছি। তার জীবনের খুঁটিনাটি অনেক কিছু জেনেছি যেগুলো দিয়ে একটা উপন্যাস লিখে ফেলা যাবে।বীনা হঠাৎ একদিন আমায় জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি লেখা শুরু করেছেন’
‘হ্যাঁ শুরু করেছি’
আমি মিথ্যে বললাম। কারণ তখনো লেখা শুরু করিনি আমি। এই মিথ্যে বুঝার মতো মন তার নেই।
এদিকে মা আমার জন্য পাত্রী দেখছে। দশদিনে তিন চারটা পাত্রী দেখার পরও পছন্দ হয়নি। মার পছন্দ হলে আমার হয়না। আমার পছন্দ হলে মার হয় না। দুজনেরই পছন্দ হলে মেয়ে ও তার পরিবারের পছন্দ হয় না। আমাকে লেখক হিসেবে আর কজনই বা চিনে। পরশুদিন মা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘তোর সাথে তো অনেক মেয়ের জানাশোনা।সেখান থেকে একজনকে নিয়ে আয় না যাকে পছন্দ হয়। আমি দেখেশুনে তার সাথে বিয়ে পড়াবো তোকে’
‘ঠিক আছে মা’
এটা মাকে নিছকই স্বান্তনা দেয়ার জন্য বললাম।

তিন দিন পরের কথা। রেস্টুরেন্টে তনুর সাথে খাওয়ার ফাঁকে সে আমাকে বললো, ‘খাওয়ার পর আপনি আমাকে বাসায় নিয়ে যাবেন।

আজকে মাকে বলে এসেছি আমার আসতে দেরি হবে’
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাকে বাসায় নেওয়ার পর যদি মা তাকে পছন্দ করে বসে!! তনু তো পছন্দ হওয়ার মতোই মেয়ে। তারপরও মুখের উপর তনুকে না করতে পারলাম না। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে তনু বললো, ‘কি ব্যাপার! আপনার বাসায় কি কেউ থাকে না নাকি যে নিতে ভয় পাচ্ছেন?’
‘আরে না।ভয় পাবো কেন? খাওয়া শেষ করেন তাড়াতাড়ি। আপনাকে মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো’
শুনে তনু খুশি হলো।
তনুকে বাসায় আনার পর মা মনে করলো আমি তাকে মেয়ে দেখাতে এনেছি। মাকে কোনভাবেই বুঝাতে পারছিলাম না। তনুকে পছন্দ করে বসলেন তিনি। বললেন, ‘এই মেয়েকেই ঘরের বউ করে আনবো। তুই নিশ্চয়ই ওকে পছন্দ করিস। তা না হলে তো একসাথে ঘুরতি না’
আমি কিছু বলতে গিয়ে পারলাম না। এখন বলাটা ঠিক হবে না। তনু চলে গেলে মাকে বুঝিয়ে বলবো যে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আরেকজনের সাথে। শুনে মা নিশ্চয়ই মনক্ষুণ্ব হবে। হলোও তাই। কিন্তু পরক্ষণেই সে মন খারাপের ভাবটা পাল্টিয়ে মুখে একটা সুন্দর হাসি ফুটিয়ে তুললেন। বালিশের নিচ থেকে একটা মেয়ের ছবি আমার চোখের সামনে ধরে বললেন, ‘দেখ তো, মেয়েটা কেমন?’
আমি ছবিটার দিকে তাকিয়ে আর চোখ সরাতে পারলাম না। মেয়েটিকে দেখেই মনে হলো কম বয়সী। সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করা ফুটফুটে দেখতে মেয়েটা আমার নজর কাড়লো। আমি বললাম, ‘মা, মেয়েটার নাম কি?’
‘সেগুলো পরে বলবো। আগে বল মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে কিনা?’
‘মেয়েটি দেখতে সুন্দর’ বললাম আমি। আমার মুখে প্রশংসা শুনে মা বললো, ‘তার মানে মেয়েটিকে তোর পছন্দ হয়েছে। সম্বন্ধটা তোর মামা এনেছে। তার শালার এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নী হয় মেয়েটি। তুই বললে কালকেই দেখতে যাবো মেয়েটিকে’
‘ঠিক আছে। তোমার যা ভালো মনে হয়’
পরদিন মেয়ে দেখতে গিয়ে লজ্জ্বায় পড়ে গেলাম। বুকের ভেতরটা ধুক ধুক করছিলো।মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে বলেই হয়তো এরকম বোধ হলো। তাছাড়া মেয়েটি আমাকে পছন্দ করবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। পছন্দ না হলে অনেক খারাপ লাগবে।
মেয়েটি চা নাস্তা নিয়ে আসলো। আমি লজ্জ্বা ভেঙে তাকালাম মেয়েটির দিকে। মাথায় এমনভাবে আচলটা দিয়েছে যার ফলে চোখটাও ঢেকে গেছে। শুধু লম্বা খাড়া নাক আর খয়েরি রংয়ের লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁটটা দেখা যাচ্ছে। ফর্সা গলায় একটা স্বর্ণের চেইন ঝুলছে।
মা বসতে বললো তাকে। বসার পর চোখগুলো দেখলাম তার। মা নাম জিজ্ঞেস করলো মেয়েটির। নাম চিত্রা। অতপর আরো কিছু প্রশ্ন করলো। নাম জানার পর বাকি প্রশ্নগুলোতে মনোযোগ দিলাম না। আমি তাকিয়ে রইলাম সুন্দর চোখ জোড়ার দিকে। চিত্রা পাঁচ মিনিট বসলো সেখানে। তারপর পায়ে হেঁটে যখন তার রুমের দিকে গেলো তখন তার চুড়ি আর নুপুরের শব্দ আমার মনে এক সংগীতের সুর সৃষ্টি করলো। মা চিত্রার বাবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমি চাচ্ছি আমার ছেলে চিত্রার সাথে আলাদা কিছুক্ষণ কথা বলুক’
চিত্রার বাবা রাজি হলো। আমি চিত্রার রুমে গেলাম। চিত্রা মাথার ঘুমটাটা নামিয়ে টেবিলে বাম হাতটা রেখে বিছানার উপর বসে আছে। আমাকে দেখে চেয়ারটা এগিয়ে দিলো। কিন্তু মাথার ঘোমটা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না।
‘খুব গরম পড়েছে’
চিত্রার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। তার কণ্ঠ যে কোকিলের মত সে জন্য নয়, অবাক হলাম সে লজ্জ্বা ভেঙে আমার সঙ্গে প্রথম কথা বললো অকুণ্ঠচিত্তে।
‘হ্যাঁ ঠিক বলেছেন’ বললাম আমি
‘আমাকে আপনি করে বলবেন না। আমি আপনার ছোট’
‘ঠিক আছে তুমি করেই বলবো’
চিত্রা একটু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনার কি কোন খারাপ অভ্যাস আছে?’
‘সিগারেট, মদ, গাঁজা এগুলোর অভ্যাস নেই। তবে অন্য একটা আছে’
‘কি সেটা?’
‘আমি মেয়েদের সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে যাই’
আমি ভেবেছিলাম চিত্রা এতে মনক্ষুণ্ন হয়ে বিয়েতে না করে দিবে। কিন্তু সে আমাকে অবাক করে দিয়ে ক্ষাণিকটা বিষণ্ন মন নিয়ে বললো,
‘বিয়ের পর না করলেই চলবে’
আমি কিছু বললাম না। আমি জানি রেস্টুরেন্টে যাওয়ার যে কাজটা আমি করি সেটা শুধু ভালো লাগা থেকেই না। যাদের সাথে রেস্টুরেন্টে যাই তারা আমার লেখা নিয়মিত পড়ে।প্রশংসা করে। তাদের কে মানা করে দিলে আমি পাঠক হারাবো। তারপরও চিত্রার সহজ সরল মায়া ভরা চেহারাটার দিকে তাকিয়ে বিয়ের পর আমি এগুলো আস্তে আস্তে বাদ দিয়ে দেবো বলে মনস্থির করলাম।
পরদিন চিত্রার বাড়ির লোকজন আমাদের বাসায় আসলো। চিত্রার বাবা আমার মাকে বললো, ‘আমাদের মেয়েরও আপনার ছেলেকে পছন্দ করেছে। তাই আজকে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে চাই’
মা বললো, ‘তাহলে আর দেরি কেন? শুভ কাজে দেরি করতে নেই’
আমি তো হতবাক। এই একদিনে চিত্রা আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে!! আমাকে লেখক হিসেবে তো সে চিনে না।তারপরও এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে গেলো বিয়েতে!! যাই হোক আমি এসব চিন্তা মন থেকে ঝেরে ফেললাম। রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের অপুর মতোই মনে মনে বলে উঠলাম, ‘আমি পাইলাম। ইহাকে পাইলাম’
জুলাইয়ের দশ তারিখ আমার বিয়ে ঠিক হলো। বিয়ের খবরটা আনি তনু আর বীনা দুজনকেই জানালাম। শুনে বীনা খুব খুশি হলো। সে বললো, ‘কই, পাত্রীর ছবি দেখি।দাওয়াত দিবেন কিন্তু আপনার বিয়েতে।
তনু প্রথমে খুশি হলেও পরে মনটা তার ভারী হয়ে উঠলো।
‘বিয়ের পর তো এভাবে আপনার সাথে সময় কাটানো হবে না’
আমি কিছু বললাম না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তনু বললো, ‘পাত্রীর ছবি আছে আপনার কাছে?’
আমি বীনা এবং তনু কাউকেই পাত্রীর ছবি দেখাতে পারলাম না। কারণ আমার কাছে ছবি ছিলো না।চিত্রাকে বলে তার একটা ছবি আমার কাছে রাখা দরকার মনে হলো পরে।
আমার কোন ভাই বোন নেই। তাই আমার বিয়ের কাজ আমাকেই করতে হলো। বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে তনু আর বীনাকে আমি সময় দিতে পারলাম না। বীনার কাহিনী নিয়ে গল্প লেখা শুরু করেছিলাম।সেটার অর্ধেকও শেষ হয়নি।

আমার বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়েটা ঝামেলা ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। বড় কোন আয়োজন হয়নি। একদম সাদাসিধে বিয়ে যাকে বলে। বিয়ের কাজ শেষ হয়েছে একদম রাত ১১টায়।চিত্রা আর আমি দুজনেই খুব ক্লান্ত ছিলাম। বাসর ঘরে গিয়ে দেখি মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। আমি গিয়ে চিত্রাকে বললাম, ‘তুমি খুব সুন্দর। তোমাকে পেয়ে আমি অনেক খুশি হয়েছি। তুমি খুশি তো এই বিয়েতে?’
‘এখনো বুঝতে পারছি না’ বলে ঘোমটার আড়ালে হাসলো একটু।
‘রাখবো। তুমি আমাকে তুমি করেই বলো’
‘বাহ রে। মাত্র বিয়ে হলো। কয়েকদিন যাক। তারপর বলি?’
‘তুমি অনেক কিউট একটা মেয়ে’ বললাম আমি। তারপর দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ক্লান্ত ছিলাম বলে সে রাতে আমাদের মধ্যে কিছু হলো না।
বিয়ের পরদিন ফোন দিলাম তনুকে। তার নাম্বার বন্ধ পেলাম। তনু কি আমার সাথে রাগ করেছে। এ বিয়েতে তো তার অসন্তোষ হওয়ার কোন কারণ দেখি না। হয়তো সে কোন একটা কাজে আটকে গেছে। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ পেলাম। দরজা খুলে দেখলাম বাইরে বীনা দাঁড়িয়ে। সে বউ দেখতে এসেছে। চিত্রাকে দেখে সে তার মুখে একটা হাসি এনে বললো, ‘ভারী মিষ্টি মেয়েতো’
চিত্রা লজ্জ্বা পেলো। বীনা বয়সে চিত্রার চেয়ে বড় হবে। তারপরও সে চিত্রাকে আপনি করেই সম্বোধন করলো।
‘চিত্রা, আপনি কি জানেন যে আপনার স্বামী একজন লেখক’
চিত্রা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে।
‘না আপু সে তো বলেনি এটা আমাকে!!’
‘আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে’
বীনাকে চা নাস্তা এনে দিলো চিত্রা। মাত্র মিনিট বিশেক বসেই প্রস্থান করলো বীনা। সে চলে যাওয়ার পর চিত্রা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি যে লেখালেখি করেন সেটা বললেন না কেন?’
‘বলার আগেই তো বিয়েতে রাজি হয়ে গেছো। যদি রাজি না হতে তাহলে বলতাম’
চিত্রা হাসলো।
ক্ষাণিক পর আবার কলিং বেল বাজলো দরজায়। এবার এক বৃদ্ধ লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। এই লোককে চিত্রা চিনে। তাদের বাড়িতে কয়েকবার গিয়েছে। এই লোক চিত্রার মায়ের প্রথম স্বামী যার সাথে ঝগড়া হয়েছিলো চিত্রার মায়ের। তাদের একটা মেয়ে হয়েছিলো। এই লোক মেয়েটিকে তার কাছে রেখে দিয়ে চিত্রার মাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।পরে চিত্রার বাবার সাথে বিয়ে হয় তার।
‘তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তোমাকে পাইনি। শুনেছি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।ঠিকানা নিয়ে চলে আসলাম। তনু খুব অসুস্থ। সে হাসপাতালে আছে। বাঁচবে না বোধ হয়’
বলে চোখ মুছলো লোকটি।
লোকটির মুখে তনুর কথা শুনে আমি অবাক হলাম। এ লোক কি সেই তনুর বাবা যেই তনুর সাথে আমি গত দুতিন মাস ধরে সময় কাটাচ্ছি। চিত্রা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তনু আপার কি হয়েছে আংকেল?’
‘ব্রেইন ক্যান্সার’
চিত্রা প্রায় কান্না করে দিচ্ছিলো। আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম। আমি লোকটিকে ভেতরে এসে বিশ্রাম নিতে বললাম। লোকটি বললো তাকে এখনি আবার হাসপাতালে যেতে হবে।যাওয়ার আগে একটা ডায়েরি চিত্রার হাতে দিয়ে বললো, ‘তনু ডায়েরিটা তোমাকে দিতে বলেছে। পারলে তোমার স্বামীকে নিয়ে তনুকে একবার দেখো এসো’
‘আমি অবশ্যই যাবো আংকেল’ বলে চোখের পানি মুছলো চিত্রা।
ডায়েরিটা আমার খুব চেনা মনে হলো। তনু একবার আমাকে নিয়ে এরকম একটা ডায়েরি কিনেছিলো লাইব্রেরি থেকে। সে বলেছিলো, ‘আমি আগে কখনো ডায়েরি লিখিনি।এখন কেন জানি লিখতে ইচ্ছে করছে’
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। চিত্রা ডায়েরিটা নিয়ে বিছানায় বসে আছে। বৃষ্টি হলেও গরম কমেনি। আমি ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে ব্যালকনিতে আসলাম। আমার মনে পড়লো, তনু একবার বলেছিলো তার মাথায় নাকি কি একটা অসুখ আছে। ক্যান্সার ট্যান্সার হবে হয়তো।আমি তখন তনুর কথাটা এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
রুমে গিয়ে দেখলাম চিত্রা ডায়েরির পাতাটা নিয়ে অঝোরে কাঁদছে। আমি ডায়েরিটা তার হাত থেকে নিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিলাম। চিত্রার মেলা পাতাটা পড়ে দেখলাম। তারিখ দেখে বুঝলাম লোখাটা বছর খানেক আগের। সেখানে লেখা আছে, ‘আমার বাবা আমাকে খুব ভালোবাসে। আমিও বাসি তাকে। কিন্তু বাবার জীবনের একটা ঘটনা নিয়ে তার প্রতি আমি খুব অসন্তুষ্ট। বাবা তার প্রথম স্ত্রী মানে আমার মাকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে তার কাছে রেখে দেয়। তারপর আমার মায়ের বিয়ে হয় আরেকজনের সাথে। সেখানে এক মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় আমার মা। সে মেয়েটি মানে আমার ছোট বোনটি সম্পর্কে মাত্র কয়েকদিন আগে জানতে পারলাম। বাবা এগুলো আমার কাছ থেকে গোপন করেছিলো।সেই সাথে আমার বোনকেও। যাই হোক, চিত্রার সাথে পরিচয় হওয়ার পর তাকে নিয়ে পরশুদিন ঘুরতে বের হলাম। অনেক কিছু কিনে দিয়েছি তাকে। সেগুলো পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলো সে। তার সাথে এতোদিন কত দূরত্ব ছিলো আমার। তাকে সেদিন কাছে পেয়ে কি যে খুশি হয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন ছিলো সেটা। ছোট বোনকে কিছু কিনের দেওয়ার চাইতে আনন্দের জিনিস দুনিয়াতে আর কি হতে পারে’
লেখাটা পড়ে আমারও বুকের ভেতরটা হাহা কার করে উঠলো। আমি চিত্রাকে বললাম, ‘কিছু রান্না করতে পারবে? আজকে রাতে তোমার বোনকে দেখতে যাবো। সাথে কিছু খাবার নিয়ে গেলে ভালো হবে’
চিত্রা কান্না থামিয়ে রান্নাঘরে গেলো। রাতে খাবার নিয়ে তনুকে দেখতে গেলাম। আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে তনু খুব অবাক হলো। একটু হেসে বললো, লেখক সাহেব তাহলে আমার বোনকেই বিয়ে করেছেন। আফসোস, আমার বোনের বিয়েতে যেতে পারিনি।সেদিনই অসুখটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো’
আমি দেখলাম তনুর মাথাটা ন্যাড়া কড়া হয়েছে। তার অসহায় চেহেরাটা দেখে চিত্রা কান্না শুরু করে দিলো। তনু বললো, ‘কাঁদিস না বোন। আমি এখনই মরবো না। তোর সাথে আরো বেশ কয়েকদিন সময় কাটিয়ে যাবো’
আমার চোখটাও কেন জানি ছলছল করে উঠলো। তনুকে বললাম, ‘আপনার বোন চিত্রার কথা আমাকে কোনদিন বলেননি’
‘আপনি আমাকে সেই সুযোগ দেন নি’
আমাদের দুজনের কথা শুনে চিত্রা অবাক হয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমরা দুজন আগে থেকেই পরিচিত?’
‘হ্যাঁ রে চিত্রা। আমরা বেশ কয়েকবার রেস্টুরেন্টে বসে গল্প করেছি। তোর স্বামী খুব ভালো মানুষ’
আমরা আরো ঘন্টা খানেক থাকলাম সেখানে। চিত্রা প্রস্থান করার আগে বলেছিলো, ‘আপু তুমি চিন্তা করো না। ভালো হয়ে যাবে তুৃমি’
কিন্তু তনু এরপর মাত্র দুদিন বেঁচেছিলো। চিত্রার আশ্বাসকে নিরাশ করে এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় উড়ন্ত বকপক্ষীদের মতোই অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিলো তনু। সেদিন চিত্রা যে কান্না করেছিলো আমার জীবনে আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখিনি। তনু মারা যাবার পরদিন তার ডায়েরিটা চিত্রা আমার কাছে দিয়ে কাঁদো গলায় বললো, ‘আমার বোনের জীবন নিয়ে আমাকে একটা গল্প লিখে দিবেন?’
আমি সযত্নে চিত্রার কাছ থেকে ডায়েরিটা নিয়ে বললাম, ‘অবশ্যই লিখবো। শুধু গল্প নয়।উপন্যাসের পাতায় তোমার বোনকে আমি জীবিত করে রাখবো’
‘নাম কি দিবেন ঠিক করেছেন?’
‘না,তুমিই বলো নাম কি দেয়া যায়?’
‘তনু আমার বোন’ বলে কান্না করে দিলো চিত্রা। আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম না। আমি তার কান্নার সঙ্গী হয়ে গেলাম।

গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখি যার মৃত্য থেকে জন্ম! এই অসাধারন গল্পটিও আমাদের ওয়েবসাইট থেকে পড়ে নিবেন।

5/5 - (9 votes)

Rajib Ahammed Sujon

I’m Rajib Ahammed, a writer at Shopnik who enjoys creating content at the intersection of education and entertainment. Whether it's simplifying complex topics or sharing engaging stories, I believe learning should be fun and accessible. From study tips to pop culture insights, I aim to keep readers informed and entertained every step of the way.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button