প্রসবের পর চুল পড়া: কারণ ও ঘরোয়া প্রতিকার
এখন ধীরে ধীরে আপনার শিশু বড় হতে থাকবে এবং আপনি সারাদিন তার কার্যকলাপের উপর নজর রাখবেন। এমন পরিস্থিতিতে নিজের যত্ন নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এই সবের মাঝে, একটি বড় উদ্বেগ যা আপনাকে প্রায়শই তাড়িত করবে তা হল আপনার চুল পড়া নিয়ে। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন ডেলিভারির পর কেন আপনার চুল এত পড়ে যাচ্ছে। যদি তাই হয়, ঘাবড়াবেন না। এই পোষ্টে, আমরা আপনার সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমরা আপনাকে বলব এটির কারণ কী এবং আপনি কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এছাড়াও, আমরা আপনাকে গর্ভাবস্থার পরে চুল পড়া কমানোর কিছু ঘরোয়া প্রতিকার বলব। আসুন প্রথমেই আপনাকে গর্ভাবস্থার পরে চুল পড়ার কারণ বলি।
Contents
কেন গর্ভাবস্থার পরে চুল পড়ে?
চুল আমাদের সারা জীবন একটি প্যাটার্নে পড়ে, যা তিনটি ভাগে বিভক্ত – অ্যানাজেন, ক্যাটাজেন এবং টেলোজেন। চুল অ্যানাজেনে বৃদ্ধি পায় এবং টেলোজেনের সময় চুল পড়ে। ক্যাটাজেন হল মধ্যবর্তী পর্যায় যেখানে চুল এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে চলে যায়। গর্ভাবস্থায়, হরমোনের পরিবর্তনের কারণে অ্যানাজেন পর্যায় স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়, যা চুল পড়া কমায় এবং চুল ঘন দেখায়। প্রসবের পরে, চুলের বৃদ্ধি চক্র স্বাভাবিক হতে শুরু করে এবং চুল পড়া শুরু হয়।
গর্ভাবস্থার পরে চুল পড়া কি সাধারণ?
যদি এটি আপনার প্রথম গর্ভাবস্থা হয়, চুল পড়া নিয়ে চিন্তা করবেন না। গর্ভাবস্থার পরে চুল পড়া একটি সাধারণ ঘটনা। সাধারণত, 90-95 শতাংশ চুল অ্যানাজেন প্রক্রিয়ায় এবং 10 শতাংশ টেলোজেনে থাকে, যার ফলে প্রতিদিন 100-150 চুল পড়ে। কিন্তু এই সময়ে আপনার চুলের গড় 30 শতাংশ টেলোজেন প্রক্রিয়ায় থাকে, যার কারণে আপনার মনে হতে পারে যে অনেক চুল পড়ে যাচ্ছে, এই সময়ে গর্ভাবস্থায় যে চুলগুলো ঝরে যাওয়া উচিত ছিল।
এবার, গর্ভাবস্থার পরে চুল পড়ার লক্ষণগুলি সম্পর্কে জানুন।
গর্ভাবস্থার পর চুল পড়ার লক্ষণ
গর্ভাবস্থার পর চুল পড়ার কোনো নির্দিষ্ট লক্ষণ নেই। সাধারণত প্রতিদিন 100-150টি চুল পড়ে যেতে পারে, কিন্তু প্রসবের পরে, একজন মহিলার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চুল পড়ে যা শ্যাম্পু, চিরুনি বা শুধু ব্রাশ করার সময় ঝাঁকুনি আকারে বেরিয়ে আসে।
পরবর্তীতে আমরা আপনাকে গর্ভাবস্থার পরে তাড়াতাড়ি চুল গজানোর চিকিৎসা এবং যত্ন সম্পর্কে বলব।
ডেলিভারির পর চুল পড়া কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
যদিও এই সমস্যাটি নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু কখনও কখনও এটি ঘটে না এবং আপনার চুল স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় না। এই ক্ষেত্রে, নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি আপনাকে সাহায্য করবে:
১. আপনার জন্য মানানসই যে কোনো চুলের তেল নিতে পারেন। হালকা গরম করে মাথায় ম্যাসাজ করুন। এটি মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালনকে উন্নত করবে, যার কারণে চুল শিকড় থেকে মজবুত হয় এবং কম ভেঙে যায়। ভালো রক্ত সঞ্চালন চুলের বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে।
২. চুলে যেকোনো ধরনের রাসায়নিক পণ্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এছাড়াও, চুলের রঙ, স্ট্রেইট করা, রিবন্ডিং ইত্যাদির মতো কোনও স্টাইল করা এড়িয়ে চলুন। এগুলো চুলকে শুষ্ক করে তোলে।
৩. চুল শক্ত করে বাঁধবেন না। এ কারণে এরা গোড়া থেকে দুর্বল হয়ে ভেঙ্গে যেতে পারে।
৪. আপনার ডায়েটে এমন খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন যা আপনার চুলের পুষ্টি জোগায়, যেমন আয়রন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, জিঙ্ক, ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন এ।
৬. আপনি যদি আপনার খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি না পান তবে ভিটামিন এবং খনিজ সম্পূরক গ্রহণের বিষয়ে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
৭. চুল অনুযায়ী শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। খেয়াল রাখবেন চুল যেন শুষ্ক না হয়। এছাড়াও মনে রাখবেন যে তারা আপনার চুল ঘন করতে সাহায্য করে।
৮. চুল পড়া বা অন্য কিছুর চাপ নেবেন না। মানসিক চাপের কারণেও চুল পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে যোগব্যায়াম করলে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি মিলবে। এছাড়াও, যোগব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে, যা চুল দ্রুত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
পরবর্তী অংশে চুল পড়া কমানোর কিছু ঘরোয়া প্রতিকার দেওয়া হয়েছে।
গর্ভাবস্থার পরে চুল পড়া কমানোর ঘরোয়া উপায়
আসুন জেনে নিই গর্ভাবস্থার পর চুল পড়ার সমস্যায় আপনি কোন ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করতে পারেন।
১। চুলের জন্য ডিম
উপাদান:
- একটি ডিম
- দুই টেবিল চামচ অলিভ অয়েল
প্রক্রিয়া:
- একটি ডিম ভেঙ্গে তার সাদা এবং হলুদ অংশ আলাদা করুন।
- একটি পাত্রে এর সাদা অংশ ভালো করে ফেটিয়ে নিন।
- এবার এতে দুই চামচ অলিভ অয়েল মেশান।
- এই মিশ্রণটি চুলের গোড়া থেকে উপরের প্রান্ত পর্যন্ত লাগান।
- মিশ্রণটি ৩০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন।
কিভাবে এটা কাজ করে: ডিমে উপস্থিত আয়রন চুল পড়া রোধ করে এবং চুল বাড়তে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি ডিমের ব্যবহারে খুশকি ও চুল পড়া থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।
২। চুল পড়ার জন্য দই
উপাদান:
- এক কাপ দই
প্রক্রিয়া:
- এক কাপে দই নিন।
- চুলের গোড়া থেকে উপরের প্রান্ত পর্যন্ত দই লাগিয়ে ভালো করে ম্যাসাজ করুন।
- এটি চুলে 10 থেকে 15 মিনিটের জন্য রেখে দিন।
- সবশেষে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
কিভাবে এটা কাজ করে: দই ভিটামিন সি এবং ভিটামিন এ সমৃদ্ধ। এই উভয় ভিটামিনের অভাবে চুল পড়া হতে পারে। অর্থাৎ দই চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং চুল ঘন করে।
৩। চুল পড়া বন্ধ করার জন্য মেথি বীজ
উপাদান:
- ১ কাপ মেথি বীজ
- দুই কাপ পানি
প্রক্রিয়া:
- আধা কাপ মেথি বীজ দুই কাপ পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন।
- সকালে পানিতে মেথি দানা ছেঁকে সেই পানি চুলের গোড়ায় লাগান।
- ১ ঘণ্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
কিভাবে এটা কাজ করে: চুলের বৃদ্ধির জন্য কিছু পুষ্টি এবং বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন, যেমন বি ভিটামিন এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য। এই দুটি উপাদানই মেথির বীজে পাওয়া যায়, যার কারণে এটি চুলের বৃদ্ধির জন্য আয়ুর্বেদিক ওষুধেও ব্যবহৃত হয়।
৪। আমলকি পাউডার
উপাদান:
- এক কাপ আমলকি গুঁড়া
- চার কাপ পানি
প্রক্রিয়া:
- এক কাপ আমলা গুঁড়ো চার কাপ পানিতে মিশিয়ে এক সপ্তাহ রেখে দিন।
- এক সপ্তাহ পর এই পানি দিয়ে চুল ধুয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- এই শ্যাম্পু, কন্ডিশনার এবং হেয়ার ডাই তিনটির কাজই করবে।
কিভাবে এটা কাজ করে: আমলকির গুণাগুণ শরীরকে শক্তিশালী করে এবং পতন রোধ করে। এর পাশাপাশি আমলকি চুলের অকালে পাকা হওয়া রোধ করে। এটি শরীরকে ক্যালসিয়াম সম্পূর্ণরূপে শোষণ করতে সাহায্য করে, যা চুলকে শক্তিশালী করে তোলে।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য
বুকের দুধ খাওয়ানো কি চুলের ক্ষতি হতে পারে?
না, বুকের দুধ খাওয়ানো এবং চুল পড়ার মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই।
প্রসবের কতদিন পর চুল পড়ে?
বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে, প্রসবের দুই থেকে চার মাস পর চুল পড়া শুরু হয় এবং 6 থেকে 24 সপ্তাহের মধ্যে পড়ে। মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে, এটি ঘটে যে এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে চুল পড়ে। সেক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আশা করি আপনি এখন বুঝতে পেরেছেন যে সমস্যাটি যা আপনাকে এতটা বিরক্ত করছিল তা গুরুতর নয় এবং সময়ের সাথে সাথে আরও ভাল হয়ে যায়। এখানে উল্লিখিত প্রতিকারগুলি আপনাকে সাহায্য করবে, যদি আপনি মাথায় রাখেন যে আপনি এমন কিছু করছেন না যা আপনার চুল খারাপ করে দিচ্ছে। আপনার যদি প্রচুর চুল পড়ে থাকে, তবে যে কোনও ওষুধ ব্যবহারের আগে একবার আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। এছাড়াও, আপনি যদি এই লেখাটি পছন্দ করেন তবে এটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
আরো পড়ুনঃ