ব্লু ইকোনমি কি এবং বাংলাদেশের সম্ভাবনা
ব্লু ইকোনমি কি – ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ। আমাদের বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে ব্যাপক ভিত্তিতে সম্পদ আহরণ করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারি। তবে সেটি কিছুটা সময়ের ব্যাপার এবং প্রয়োজন বিদেশি সহায়তা ও সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
Contents
ব্লু ইকোনমি কি ? blue economy
সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি বলতে যা বোঝায় সেটি হচ্ছে, সমুদ্রের রং নীল। আর সেকারণেই সমুদ্রকেন্দ্রীক যে অর্থনীতি তাকে সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি বলা হয়। তবে বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ব্লু ইকোনমির আধুনিক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, সমুদ্রে যে পানি আছে এবং এর তলদেশে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে সেই সবধরনের সম্পদকে যদি আমরা টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করি তবে তাকে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি বলে।
ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনার ক্ষেত্রটা আসলে কতটুকু?
২০১৪ সালে মিয়ানমারের কাছ থেকে আমরা সমুদ্র জয় করেছি। এতে আমাদের সমুদ্রসীমা বেড়েছে পুরো বাংলাদেশের সমান প্রায় আরেকটি অংশ। বাংলাদেশের বর্তমান সমুদ্র সীমার আয়তন ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার
যেহেতু আমাদের সমুদ্রসীমা অনেক বেড়েছে ফলে এই বিশাল পরিমাণ সমুদ্রকে আমরা কীভাবে কাজাতে লাগাতে পারি সেটাই মূখ্য বিষয় বা এই সমুদ্র থেকে আমরা কী কী সম্পদ পেতে পারি সেটা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।
আর সমুদ্র সম্পদের মধ্যে বলব যখন থেকে সমুদ্র আছে তখন থেকেই সমুদ্র বাণিজ্য চলছে। আমাদের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দেশ বিদেশে অনেক সুনাম অর্জন করেছে এবং এরমাধ্যমে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছি।
সামুদ্রিক মাছ নিয়ে আমি কিছু কথা এখানে বলতে চাই। আমরা জানি সমুদ্রের মাছ আমাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে। তবে আমাদের কি পরিমাণ সামুদ্রিক মাছ আছে সেটা আমরা এখনও জানি না। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলছে।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে একটি বিষয় জানা গেছে। সেটি হচ্ছে আমাদের সমুদ্রের মধ্যে একটি গিরিখাদের মতো জায়গা রয়েছে। যার পরিমাণ ১ হাজার ৭ শ ৩৮ বর্গকিলোমিটার। এর গভীরতা ৯ শ মিটার। যা যেকোনো প্রজাতির মাছের প্রজননের জন্য খুবই ভালো একটি অঞ্চল। এর কারণে আমাদের জীববৈচিত্র ধরে রাখার বিষয়টি খুবই সহায়ক হচ্ছে।
সমুদ্রের অফুরন্ত সম্ভাবনার মধ্যে মাছের বাইরে রয়েছে, জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজি, তেল-গ্যাস, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজভাঙা শিল্প, সামুদ্রিক জলজ প্রাণীর চাষাবাদ, লবণ উৎপাদন, সমুদ্র পর্যটন। শিপিং শিল্পের কথা না বললেই নয়। জাহাজ নির্মাণ আমরা শুরু করেছি। তবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কারণে জাহাজভাঙা শিল্পটি আপাতত বন্ধ আছে। আগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজ আসত আমাদের এখানে। সেগুলো ভাঙার কাজ করা হতো। কিন্তু আমাদের পরিবেশবিদরা বলছেন এই পুরনো জাহাজভাঙার ফলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমুদ্রের পানি নষ্ট হচ্ছে। যে কারণে জাহজ ভাঙার পরিবর্তে এখন নতুন নতুন জাহাজ নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি খুব লাভজনক একটি শিল্প।
বঙ্গোপসাগরে ভারতের হাতে থাকা ১০ টি গ্যাস ব্লকের মধ্যে ৮ টি এবং মিয়ানমারের ১৮টির মধ্যে ১৩ টির মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট(টিসিএফ) গ্যাস পাওয়া সম্ভব। তেল-গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে আছে রুটাইল, ইলমেনাইট, গার্নেট, মোনাজাইট, ম্যাগনেটাইট, কায়ানাইট, লিউকক্সিন ও জিরকনসহ মূল্যবান খনিজ পদার্থ রয়েছে।
বাংলাদেশ মালেয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের সাথে একত্রে সমুদ্র তলদেশের সম্পদ উত্তোলনে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে এখনো বলার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারে নি। সরকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে এগোচ্ছে। ভালো একটা পর্যায়ে যেতে অন্তত ৪/৫ বছর সময় এখনও লাগবে। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা এবং ঢেউ থেকে শক্তি আহরণের জন্য মহেশখালিতে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমুদ্রে ৭ ফুট উচ্চতার ঢেউয়ের প্রয়োজন হয়। সেটি আমাদের বঙ্গোপসাগরে রয়েছে এবং পতেঙ্গা ও সেন্টমার্টিনসহ কয়েকটি জায়গায় এ ধরনের প্রকল্প হয়েছে। তবে আবারও বলছি বড় ধরনের উদ্যোগের কথা এখনও পর্যন্ত সেভাবে শোনা যায় নি।।
মহেশখালিতে off shore wind Energy প্রকল্প রয়েছে। বায়ু শক্তি উৎপাদনের জন্য এ পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এসব কাজে সফলতার জন্য আমাদের বিদেশি সাহায্য, প্রুযুক্তি ও দক্ষ জনশক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু আমি যতটুকু জেনেছি আমাদের সরকার বিদেশি সাহায্যের ওপর খুব একটি নির্ভর করতে চাচ্ছে না। স্বনির্ভরতার মাধ্যমে এগোতে চাচ্ছে আমাদের সরকার। সুনীল অর্থনীতি সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন ও তা বিকাশে দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে আমাদের দেশে Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Maritime University Bangladesh নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে Oceanography বিভাগ চালু করা হয়েছে। এভাবে একসময় আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে বলে আশা করছি।
১০ পয়েন্টে বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমি সম্ভাবনাঃ
‘ব্লু ইকোনমি’ সময়ের আলোচিত বিষয়। ২০৪১ এর উন্নত বাংলাদেশ গঠনে সমুদ্রে পাওয়া ১,১৮,৮১৩ বর্গ কি. মি. এর যথাযথ ব্যবহারে সামুদ্রিক অর্থনীতি হয়ে উঠতে পারে ট্রামকার্ড।
(১) কিছুদিন আগে গৃহীত হয়েছে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০। এ মহাপরিকল্পনায় সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনায় নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ৫ ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হলো সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ দ্রুত সম্পন্ন করা। এর মাধ্যমে সরকার সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগানোর জন্য প্রথম এবং প্রধান কাজটিই হাতে নিয়েছে।
(২) সমুদ্র বিজয়ের ফলে বাংলাদেশ যে অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে, সেখানে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব। ক্ষেত্র চারটি হলো তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন।
(৩) সুস্থির সামুদ্রিক কার্যক্রমের নিমিত্তে বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক ব্লু প্রোগ্রামের ( PROBLUE) জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলারের ফান্ড গঠন করা হয়েছে। যার সাইনিং সম্পাদিত হয়েছে নভেম্বর ২০১৮ তে। বাংলাদেশে সামুদ্রিক খাতেও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বিনিয়োগ সম্ভাবনা রয়েছে।
(৪) বঙ্গোপসাগর তীরে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও থাই উপকূলে ১৪৫ কোটি মানুষের বাস। বাংলাদেশের অবস্থান কেন্দ্রে। ফলে এখানকার বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সুফল বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার ভালো সুযোগ রয়েছে।
(৫) বর্তমানে বাংলাদেশের ট্রলারগুলো উপকূল থেকে ৩৫-৪০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে মাছ আহরণ করে। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০০ নটিক্যাল মাইল। আরও বিস্তৃত পরিসরে কাজ করে সমুদ্র অর্থনীতিতে দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় করার বিশেষ সুযোগ রয়েছে।
(৬) জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ( FAO) মতে, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। নতুন জলসীমার অধিকার পাওয়ায় ব্লু ইকোনমি প্রসারে বাংলাদেশের এ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তাই সমুদ্র খাতের এ সুযোগ লুপে নেয়াই এখন কাজ।
(৭) ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২১টি সদস্য দেশের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রিম অ্যাসোসিয়েশন-IORA’ এর সদস্য বাংলাদেশ। ব্লু ইকোনমি নিয়ে এ জোটের বিভিন্ন দেশ কাজ করছে।
(৮) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (DCCI) হিসাব মতে, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ আসে সমুদ্রে মাছ আহরণ, সামুদ্রিক খাদ্য ও বাণিজ্যিক সমুদ্র পরিবহন হতে। প্রায় ৩ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল সামুদ্রিক মাছ আহরণে নিয়োজিত আছে ৫০ লাখ মানুষ। এ খাতে আধুনিকায়ন হলে এ সংখ্যা বাড়া কেবল সময়ের ব্যাপার।
(সূত্রঃজনকণ্ঠ, ২৭ জুলাই ২০১৭)
(৯) সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ‘ক্লে’র সন্ধান পাওয়া গেছে বঙ্গোপসাগরের প্রায় ৩০ থেকে ৮০ মিটার গভীরে । অগভীর সমুদ্রের ক্লে উত্তোলন করা যায় গেলে বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এছাড়াও সমুদ্র তলদেশে মহামূল্যবান ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিশ্বে এ ধাতু দুটির চাহিদা কিরূপ তা সহজে অনুমেয়।
(১০) সমুদ্র নির্ভর অর্থনীতি থেকে যদি ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়, তাহলে ভিশন ২০৪১ পূর্ণ করা সহজ হবে। ফলে আমরা এই সময়ের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে যাব।
তবে আমরা আসলে সুনীল অর্থনীতির একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। আমাদের এই মুহূর্তে দরকার এ বিষয়ে একটি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা। কিভাবে আমরা ব্লু ইকোনমিকে এগিয়ে নিতে পারব সে ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণা করা। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে প্রতিবেশীসহ অন্যান্য দেশ যারা ব্লু ইকোনমিতে এগিয়ে আছে তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে বিষয়টি ভালোভাবে জেনে নেয়া। আমরা কিভাবে এগোতে পারি সে ব্যাপারে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা ও সর্বোচ্চ সহযোগিতা নেয়া উচিত। আর সেদিক থেকে আমি মনে করি ব্লু ইকোনমি নিয়ে ‘আইওরা’ যে সম্মেলনটি হয়েছে ঢাকায় সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
Conclusion
এই পোস্ট থেকে ব্লু ইকোনোমি কি এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন আশা করছি। যদি আপনার কাছে আমাদের এই পোস্ট ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই শেয়ার করুন।
আরো পড়ুন
বৃত্তাকার অর্থনীতি
চর্যাপদ কি এবং বিসিএস বাংলা সাহিত্যে প্রস্তুতির গাইডলাইন এই পোস্ট দুটি অবশ্যই পড়ে নিবেন।