অপরাজিতা ফুলের উপকারিতা ও অপকারিতা
অপরাজিতা, যা বাগান এবং বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়। আয়ুর্বেদে সাদা ও নীল অপরাজিতা ফুলের গাছকে খুবই উপকারী বলা হয়েছে। নারী, পুরুষ, শিশু ও বয়স্কদের রোগ নিরাময়ে অপরাজিতা ফুলের ব্যবহার খুবই উপকারী। দুরারোগ্য রোগকে জয় করার ক্ষমতার কারণে এটি অপরাজিতা নামে পরিচিত।
অপরাজিতা সাধারণ থেকে গুরুতর রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রদাহের জন্য উপকারী। আসুন জেনে নিই অপরাজিতা এর গুনাগুন সম্পর্কে-
অপরাজিতা কি?
অপরাজিতা একধরণের ফুলের গাছ। এর বোটানিকাল নাম Clitoria ternatea L। এর ফুল আসে বিশেষ করে বর্ষায়। অপরাজিতা ফুল দেখতে গরুর কানের আকৃতির, তাই একে গোকর্ণীও বলা হয়। সাদা ও নীল ফুলের পার্থক্যে অপরাজিতা দুই প্রকার। তবে সাদা অপরাজিতা বেশি উপকারী।
অপরাজিতা উদ্ভিদের দরকারী অংশ–
- মূল
- মূলের ছাল
- পাতা
- ফুল
- বীজ
অপরাজিতা ফুল গাছের উপকারিতা ও ব্যবহার
১। মাইগ্রেন থেকে মুক্তি পেতে – অপরাজিতা বীজ এবং মূল সমান অংশ পানি দিয়ে পিষে নিন। এর ফোঁটা নাকে দিলে মাইগ্রেনে উপকার পাওয়া যায়। এর শিকড় কানে বেঁধে দিলেও উপকার পাওয়া যায়। বীজ, শিকড় এবং শুঁটি আলাদাভাবে ব্যবহার করা যায়।
২। চোখের রোগে- সাদা অপরাজিতা ও পুনর্নব মূলের পেস্টে বার্লি পাউডারের সমান অংশ মিশিয়ে নিন। এটি পানির সাথে পিষে চোখে লাগালে চোখের যাবতীয় রোগ সেরে যায়। অপরাজিতা দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে ব্যবহৃত হয় কারণ আয়ুর্বেদে অপরাজিতাকে বলা হয় চক্ষুষ্য যার অর্থ চোখের জন্য উপকারী।
৩। কানের ব্যথার জন্য – অপরাজিতা গাছের পাতার রস শুকিয়ে গরম করে নিন। এটি কানের চারপাশে লাগালে কানের ব্যথায় আরাম পাওয়া যায়।
৪। দাঁতের ব্যথায়- অপরাজিতার মূলের একটি পেস্ট তৈরি করুন। এর মধ্যে কালো গোলমরিচের গুঁড়া মিশিয়ে মুখে রাখুন। এটি দাঁতের ব্যথায় দারুণ উপশম দেয়।
৫। গলার ব্যাধি নিরাময় করে–
- ১০ গ্রাম অপরাজিতা পাতা ৫০০ মিলি পানিতে রান্না করুন। অর্ধেক অবশিষ্ট থাকলে ফিল্টার করুন। এইভাবে প্রস্তুত করা ক্বাথ দিয়ে গার্গল করলে টনসিল, গলা ব্যথায় আরাম পাওয়া যায়।
- অপরাজিতা মূলের একটি পেস্ট সাদা ফুলের সাথে ঘি মিশিয়ে খান। এটি গলার রোগে উপকারী।
- সাদা ফুলের অপরাজিতার শিকড় অ্যালোভেরা বা অ্যালোভেরার তন্তুতে মুড়িয়ে হাতে বেঁধে দিন। এটি গলগন্ড নিরাময় করে।
- ১ গ্রাম সাদা অপরাজিতার মূল পিষে সকালে পান করে চর্বিযুক্ত খাবার খেলে গলগন্ডে উপকার পাওয়া যায়।
- ১-২ গ্রাম সাদা অপরাজিতার মূলের গুঁড়ো ঘি দিয়ে মিশিয়ে গলার ভিতর ঘষলে গলগন্ড সেরে যায়।
৬। পাচনতন্ত্রের রোগে- সাদা অপরাজিতা গাছের মূল উপড়ে গলায় বেঁধে দিন। এছাড়া এর মূলের গুঁড়া প্রতিদিন গরুর দুধ বা গরুর ঘি দিয়ে খান। এ কারণে বদহজম, পেটে জ্বালাপোড়া ইত্যাদি সমস্যায় দ্রুত উপকার পাওয়া যায়।
৭। কাশি সারাতে- অপরাজিতা মূল থেকে শরবত প্রস্তুত করুন। অল্প অল্প করে পান করলে কাশি, শ্বাসকষ্টের সমস্যা এবং শিশুদের হুপিং কাশিতে উপকার পাওয়া যায়।
৮। পেটের রোগে- অপরাজিতার ভুনা বীজের আধা গ্রাম গুঁড়ো করে নিন। এই গুঁড়ো আগুনে ভাজুন বা আগুনে ১-২ টি বীজ ভাজুন। ছাগলের দুধ বা ঘি দিয়ে দিনে দুবার সেবন করুন। এটি অ্যাসাইটিস (পেটে পানি ভর্তির সমস্যা), আফরা (পেটে গ্যাস), কমলা (জন্ডিস) এবং পেটের ব্যথায় দ্রুত উপশম দেয়।
৯। প্লীহা ডিসঅর্ডারের চিকিৎসায়- অন্যান্য রেচক ও মূত্রবর্ধক ওষুধের সাথে অপরাজিতা গাছের মূল মিশিয়ে নিন। এটি প্লীহা (প্লীহা বড় হওয়া), আফরা (পাকস্থলীতে গ্যাস) এবং প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া রোগ নিরাময় করে।
১০। জন্ডিসে উপকারী- ৩-৬ গ্রাম অপরাজিতা গুঁড়ো বাটার মিল্কের সাথে ব্যবহার করুন। এটি জন্ডিসে উপকারী। এছাড়া আধা গ্রাম অপরাজিতা ভুনা বীজের গুঁড়া তৈরি করুন। এই গুঁড়ো আগুনে ভাজুন বা আগুনে ১-২ টি বীজ ভাজুন। ছাগলের দুধ বা ঘি দিয়ে দিনে দুবার সেবন করুন। এতে জন্ডিসে দ্রুত উপকার পাওয়া যায়।
১১। প্রস্রাবের সমস্যা নিরাময়ে-
- অপরাজিতা গাছের মূলের গুঁড়া ১-২ গ্রাম গরম পানি বা দুধের সাথে দিনে ২/৩ বার খান। এটি প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর করে।
- প্রস্রাব কম হলে সেবন করলেও উপকার পাওয়া যায়।
- চাল ধোয়ার সাথে অপরাজিতা মূলের গুঁড়ো পিষে নিন। এটি ছেঁকে নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা কয়েকদিন পান করলে মূত্রাশয়ের পাথর ভেঙ্গে যায়।
১১। হাইড্রোসিল ডিসঅর্ডারে- অপরাজিতা বীজ পিষে নিন । এই পেস্ট প্রয়োগ করে অণ্ডকোষের প্রদাহ নিরাময় করা হয়।
১২। গর্ভাবস্থায়- ১-২ গ্রাম সাদা অপরাজিতা ছাল বা পাতা ছাগলের দুধে পিষে নিন। ছেঁকে নিয়ে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে গর্ভপাতের সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়।
১৩। প্রসব ব্যথা কমাতে- সহজে ডেলিভারির জন্য , অপরাজিতা লতাটি মহিলার কোমরে মুড়ে দিন। এটি ডেলিভারি সহজ করে তোলে। প্রসব বেদনা কমে যায়।
১৪। গনোরিয়ায় উপকারী- ৩-৬ গ্রাম অপরাজিতা মূলের ছাল, ১ গ্রাম নরম চিনি এবং ১ গ্রা্ম কালো গোলমরিচ নিন। এই তিনটি পানি দিয়ে পিষে ছেঁকে নিন। সাত দিন সকালে এটি পান করুন। এর সাথে রোগীকে অপরাজিতা পঞ্চাঙ্গের (ফুল, পাতা, কাণ্ড ও মূল) ক্বাথ বসিয়ে দিন । এটি গনোরিয়াতে উপকার দেয়। এটি লিঙ্গ সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করে।
১৫। আর্থ্রাইটিস- অপরাজিতার পাতা পিষে জয়েন্টে লাগালে বাতের ব্যথা উপশম হয়। ১-২ গ্রাম অপরাজিতা মূলের গুঁড়া গরম জল বা দুধের সাথে দিনে ২/৩ বার খান। গাউটে এটি উপকারী।
১৬। এলিফ্যান্টিয়াসিসে-
- ১০-২০ গ্রাম অপরাজিতা শিকড় অল্প পানিতে পিষে গরম করুন। এর সাথে ৮-১০টি পাতার পেস্ট বানিয়ে সেঁকে নিলে ফাইলেরিয়াসিস এবং নারু রোগে উপকার পাওয়া যায়।
- ধব, অর্জুন, কদম্ব, অপরাজিতা এবং বন্দকের মূলের একটি পেস্ট তৈরি করুন। এটি ফুলে যাওয়া স্থানে লাগালে ফাইলেরিয়াসিসে উপকার পাওয়া যায়।
১৭। ক্ষত নিরাময়ে– হাতের তালুতে বা আঙ্গুলের ক্ষত বা খুব বেদনাদায়ক ক্ষতস্থানে ১০-২০ টি অপরাজিতা পাতার ডাল বেঁধে দিন। এতে ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে দিলে খুব দ্রুত আরাম পাওয়া যায়। অপরাজিতা গাছের ১০-২০ গ্রাম মূল কাঞ্জি বা ভিনেগার দিয়ে পিষে নিন। এই পেস্ট লাগালে পাকা ফোঁড়া সেরে যায়।
১৮। লিউকোডারমার চিকিৎসার জন্য- সাদা অপরাজিতার মূল ঠান্ডা জলে পিষে নিন। আক্রান্ত স্থানে লাগালে ১৫-৩০ দিনের মধ্যে সাদা দাগ উঠে যায়।
দুই ভাগ অপরাজিতার মূল ও এক ভাগ চক্রমর্দ শিকড় পানিতে পিষে লাগালে শ্বেত কুষ্ঠ রোগে উপকার পাওয়া যায়।
অপরাজিতার বীজ ঘিয়ে ভেজে সকাল-সন্ধ্যা পানির সঙ্গে সেবন করলে দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে শ্বেত কুষ্ঠ রোগে উপকার পাওয়া যায়।
১৯। মুখের ফ্রেকলস ট্রিটমেন্ট- অপরাজিতা এর মূলের ছাই মুখে ঘষুন। এই পেস্ট মুখে লাগালে মুখের পিম্পল দূর হয়।
২০। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে- ডায়াবেটিসে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে অপরাজিতা ব্যবহার করতে পারেন, কারণ একটি গবেষণা অনুযায়ী অপরাজিতাতে অ্যান্টি-ডায়াবেটিক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
২১। স্নায়ুতন্ত্রের জন্য উপকারী– অপরাজিতা লতা স্নায়ুতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ব্যবহার করা হয় কারণ একটি গবেষণা অনুসারে, অপরাজিতাতে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার কারণে এটি স্নায়ুতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।
২২। বিষণ্নতায়- অপরাজিতা বিষণ্ণতা কমাতে ব্যবহার করা হয় কারণ আয়ুর্বেদ অনুসারে, অপরাজিতা যা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, যার ফলে বিষণ্নতার লক্ষণগুলি হ্রাস পায়।
২৩। হার্টের জন্য- অপরাজিতা বীজ হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে, কারণ এতে রয়েছে অ্যান্টি-হাইপারলিপিডেমিক বৈশিষ্ট্য যা কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
২৪। হাঁপানি থেকে মুক্তি পেতে- আপনি যদি হাঁপানির সমস্যায় অস্থির হয়ে থাকেন, তাহলে অপরাজিতা ব্যবহার করলে এই সমস্যা কমতে পারে।
২৫। জ্বর কমাতে – অপরাজিতার বেল কোমরে বেঁধে রাখলে জ্বর থেকে সহজে উপশম পাওয়া যায়।
২৬। সাপের কামড়ে- সরপক্ষী ও সাদা অপরাজিতা মূলের ক্বাথের সাথে ঘি রান্না করুন । এতে শুকনো আদা, ভাংড়া (ভ্রংরাজ), ভাচা এবং হিং যোগ করুন। তেঁতুলের সঙ্গে দিলে সাপের বিষের প্রভাব নষ্ট হয়।
কিভাবে অপরাজিতা সেবন করবেন –
রস – ১০ মিলিগ্রাম এবং গুঁড়া – ১-২ গ্রাম
সর্বাধিক উপকারের জন্য ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে অপরাজিতা ব্যবহার করুন।
আরো দেখুনঃ