স্বাস্থ্য

ইসবগুলের উপকারিতা ও ব্যবহার

সাধারনত মানুষ জানে যে, ইসবগুলের ভুসি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, ইসবগুলের ভুসি এর সাথে এর কান্ড, পাতা, ফুল, শিকড় ও বীজও অনেক উপকারী। ইসবগুল ব্যবহার করে আপনি অনেক ধরনের রোগ নিরাময় করতে পারেন।

ইসবগুল কি?
ইসবগুলের ল্যাটিন নাম হল Plantago ovata এবং এটি Plantaginaceae পরিবারের একটি উদ্ভিদ।
ইসবগুলের বীজের আকার ঘোড়ার কানের মতো হওয়ায় এর নাম হয় ইসবগুল। প্রাচীন আয়ুর্বেদ গ্রন্থে এর বর্ণ্না উল্লেখ রয়েছে। ১০ শতকের গোড়ার দিকে আরবি হাকিমরা ইসবগুলকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতেন। মুঘলদের আমলেও ইসবগুল ব্যবহৃত হত।

আয়ুর্বেদ অনুসারে, ইসবগুলের প্রভাব ঠান্ডা। আজও এটি দীর্ঘস্থায়ী আমাশয়, অন্ত্রের প্রদাহ এবং জ্বালা সংক্রান্ত সমস্যা নিরাময় করে। তবে এটি গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মহিলাদের ব্যবহার করা উচিৎ নয়।

ইসবগুল দুই ধরনের হয়:
১। ইসবগুল
২। বন্য ইসবগুল

ইসবগুল কতটা খাবেন?
ভুসি গুঁড়া – ৫-১০ গ্রাম।
সর্বাধিক উপকারের জন্য, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিন।

ইসবগুল এর কি কি ব্যবহার করবেন?

  • কাণ্ড
  • পাতা
  • ফুল
  • মূল এবং
  • বীজ

ইসবগুলের উপকারিতা ও ব্যবহার

আয়ুর্বেদ মতে, ইসবগুলের ব্যবহার শরীরকে সুস্থ রাখে। এর বীজ প্রস্রাব বাড়াতে, প্রদাহ নিরাময়ে, কফের সমস্যা এবং বীর্যের সমস্যা নিরাময় করতে পারেন । এর ভুসি মলকে হালকা করতে কাজ করে।

ইসবগুলের ঔষধি ব্যবহার, পরিমাণ ও ব্যবহারের পদ্ধতিগুলো হল:-

স্থুলতা হ্রাস করতেঃ ইসবগুল ব্যবহারে স্থুলতা কমে। এটি তার নিজের ওজনের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি জল শোষণ করে। এটি হজমে সাহায্য করে এবং ফাইবারের একটি ভালো উৎস। তাই পেট কমানোর চিকিৎসা হিসেবে ইসবগুল ব্যবহার করা যায়।

চুলকানির সমস্যায়ঃ বুনো ইসবগুল পাতার ক্বাথ তৈরি করে চুলকানি অংশ ধুয়ে ফেললে চুলকানির সমস্যা দূর হয়।

কোষ্ঠকাঠিন্যেঃ এক চামচ ইসবগুলের ভুসি ঘুমানোর সময় কুসুম গরম পানি বা দুধের সাথে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য সেরে যায়। ইসবগুলের ভুসি ও ত্রিফলা গুঁড়ো সমপরিমাণে মিশিয়ে নিন। এটি প্রায় ৩-৫ গ্রাম কুসুম গরম পানির সাথে রাতে খেলে সকালে মলত্যাগে কোনো সমস্যা হয় না।

আমাশয় নিরাময়েঃ

  • দু’চামচ ইসবগুলের ভুসি দইয়ের সঙ্গে দিনে ২-৩ বার খেলে দীর্ঘস্থায়ী আমাশয় ও রক্ত ​​আমাশয়ে উপকার পাওয়া যায়। ইসবগুলের বীজ ভাজা খেলেও আমাশয় নিরাময় হয়।
  • ইসবগুলের বীজ এক লিটার পানিতে ফুটিয়ে নিন। অর্ধেক পানি অবশিষ্ট থাকলে তিন ভাগ করে দিনে তিনবার দিলে সব ধরনের আমাশয়, পেটের পীড়া, ডায়রিয়া ইত্যাদিতে উপকার পাওয়া যায়।
  • ১০০ গ্রাম ইসবগুলের ভুসিতে ৫০ গ্রাম মৌরি ও চিনি মিশিয়ে ২-৩ চামচ করে দিনে ২-৩ বার খেলে অ্যামিবিক আমাশয়ে উপকার পাওয়া যায়।
  • পানিতে ইসবগুলের বীজ দিয়ে ঘন ক্বাথ তৈরি করুন। এর সাথে চিনি মিশিয়ে পান করলে অ্যামিবিক আমাশয়, সাধারণ এবং মারাত্মক ডায়রিয়া, শূল সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

শিশুদের ডায়রিয়া কমাতেঃ শিশুদের বারবার ডায়রিয়ায় ইসবগুল ব্যবহার খুবই উপকারী।

  • ইসবগুলের গোটা বীজ বা ১০ গ্রাম ইসবগুলের ভুসি ঠাণ্ডা পানির সাথে খান অথবা কিছু পানিতে ভিজিয়ে ফুলে উঠলে সেবন করুন। এটি অন্ত্রের ব্যথা এবং প্রদাহ নিরাময় করে।
  • বন্য ইসবগুল বীজের গুঁড়া ১-২ গ্রাম খেলে ডায়রিয়া ও আমাশয় উপশম হয়।

মাথাব্যথা থেকে উপশমেঃ ইসবগুল ইউক্যালিপটাস পাতার সাথে পিষে কপালে লাগালে মাথাব্যথা দূর হয়।

ঠাণ্ডায় ইসবগুলঃ ইসবগুলের ক্বাথ ১৫-২০ মিলি সেবনে সর্দি-কাশিতে উপকার পাওয়া যায়।

কাশি নিরাময় করেঃ বন্য ইসবগুল পাতার ক্বাথ দিয়ে কুলি করলে কাশিতে উপকার পাওয়া যায়।

কানের ব্যথা নিরাময়েঃ

  • ১০ গ্রাম ইসবগুলের দ্রবণে ১০ মিলি পেঁয়াজের রস মেশান। এটিকে গরম করুন এবং কানে ১-২ ফোঁটা দিন। এটি কানের ব্যথা নিরাময় করে।
  • বন্য ইসবগুল পাতার রস ১-২ ফোঁটা কানে লাগালে কানের ব্যথা দূর হয়।

মুখের আলসারের জন্যঃ ইসবগুলের দ্রবণ দিয়ে গার্গল করলে মুখের ঘা রোগে উপকার পাওয়া যায়।

দাঁতের ব্যথা নিরাময়েঃ

  • ইসবগুল ভিনেগারে ভিজিয়ে দাঁতের নিচে রাখলে দাঁতের ব্যথায় উপশম হয়।
  • বুনো ইসবগুল পাতা পিষে মাখনের সাথে মিশিয়ে দাঁতে মালিশ করলে মাড়ির ফোলাভাব দূর হয়।

শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায়ঃ ইসবগুলের 3-5 গ্রাম বীজ সকালে কুসুম গরম পানিতে খেলে শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি রোগে উপকার পাওয়া যায়।

পাইলসের চিকিৎসায়ঃ ইসবগুলের শরবত বানিয়ে খেলে রক্তাক্ত পাইলসের রক্ত ​​পড়া বন্ধ হয়।

মূত্রনালীর সমস্যাঃ

  • এক গ্লাস পানিতে চার চামচ ইসবগুলের ভুসি ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পর স্বাদমতো চিনি মিশিয়ে পান করলে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া শেষ হয়।
  • এক গ্রাম ইসবগুলের ভুসি ২ গ্রাম ঠাণ্ডা লঙ্কা ও ৫০০ মিলিগ্রাম কলমি সোরা মিশিয়ে খেলে ঘনঘন প্রস্রাবের সমস্যায় উপশম হয়।

রাতকানা রোগের চিকিৎসায়ঃ সমপরিমাণ ইসবগুল ও চিনি মিশিয়ে নিন। ঘুমানোর এক ঘন্টা আগে আধা গ্লাস দুধের সাথে এক চামচ পরিমাণে সেবন করুন।

বাতের চিকিৎসার জন্যঃ জয়েন্টের ব্যথায় ইসবগুলের পল্টিস (ব্যান্ডেজ) বেঁধে দিলে উপকার পাওয়া যায়।

চোখের রোগ নিরাময়েঃ বন্য ইসবগুল পাতার ক্বাথ তৈরি করে চোখ ধুলে জ্বালাপোড়া দূর হয়।

হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখতেঃ হার্টকে সুস্থ রাখতে ইসবগুল খাওয়া উপকারী কারণ একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ইসবগুল কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে হার্টের কার্যকারিতা ঠিক রাখে।

কাশি থেকে মুক্তি পেতেঃ ইসবগুল খেলে কফের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় কারণ ইসবগুল খেলে কফ দূর করা সহজ হয়।

আলসারেঃ ইসবগুল সেবন আলসারের উপসর্গ কমাতে সহায়ক, কারণ আয়ুর্বেদ অনুসারে এতে পিত্ত প্রশমনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আলসারের উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে।

আরো পড়ুনঃ পিত্তথলির পাথর হওয়ার কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার, লজ্জাবতী গাছের উপকারিতা ও ব্যবহারের নিয়ম, সুপারি খাওয়ার উপকারিতা ও নিয়ম এবং অপকারিতা

জ্বালাপোড়ায় উপকারীঃ ইসবগুলের ব্যবহার পেটের জ্বালাপোড়াকে শান্ত করতে সাহায্য করে কারণ ইসবগুলের একটি শীতল প্রভাব রয়েছে যা পেটের জ্বালাকে শান্ত করতে সাহায্য করে।

কোলেস্টেরল কমাতেঃ ইসবগুলের ব্যবহার কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক কারণ গবেষণা অনুসারে, ইসবগুলে কোলেস্টেরল কমানোর বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

ডায়াবেটিসে উপকারীঃ ইসবগুল খাওয়া ডায়াবেটিসে উপকারী, কারণ ইসবগুল খেলে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

আরো পড়ুনঃ ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা ডায়েট চার্ট ও প্ল্যান, রসুনের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম, কাঁচা ও ভাঁজা রসুন

ইসবগুল রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেঃ ইসবগুলের ব্যবহার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, কারণ একটি গবেষণা অনুসারে, এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত নিরাময় করেঃ বন্য ইসবগুলের পাতা পিষে ক্ষতস্থানে লাগালে রক্ত ​​পড়া বন্ধ হয় এবং ক্ষত দ্রুত সেরে যায়।

বিষাক্ত পোকার কামড়েঃ ইসবগুলের পাতা পিষে পোকার কামড়ের জায়গায় লাগান। এটি ফোলা, জ্বালাপোড়া এবং ব্যথা নিরাময় করে।

ইসবগুলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া-

  • বন্য ইসবগুল ব্যবহারে অস্থিরতা এবং ত্বকের রোগ হতে পারে।
  • এটি অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে রক্তচাপ কম হতে পারে।
  • ডায়রিয়ার সমস্যা হতে পারে।
  • ইসাবগোল নাড়ি দুর্বল করে এবং ক্ষুধা দূর করে। এই ওষুধটি গর্ভবতী মহিলার জন্যও ক্ষতিকর।
  • ইসাবগোলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে লিন্ডেন বীজ এবং মধু নিন।

সতর্কতাঃ বিভিন্ন রোগে ব্যবহারের আগে অবশ্যই একজন আয়ূর্বেদিক ডাক্তার বা আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এই ঔষুধটি রোগ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে কাজ করবে, তবে তার আগে আপনার রোগের ধরণ জানা জরুরি। মনে রাখবেন, শুধুমাত্র ইসবগুলের ব্যবহার আপনার রোগের সমাধান নয়।

ইসবগুল কোথায় পাওয়া যায় বা জন্মায়?

ইসবগুল গাছের উৎপত্তিস্থল ইরান এবং সেখান থেকে বাংলাদেশে আসে।

আরো পড়ুনঃ

5/5 - (13 votes)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button