ডায়রিয়া হলে করণীয় কি এবং দ্রুত সুস্থ হওয়ার উপায়
যে কেউ ডায়রিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়রিয়ার কারণে ব্যক্তির স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সময়মতো ডায়রিয়া বন্ধ করা না গেলে হাসপাতালে যেতে হয়। সাধারণত ডায়রিয়া হলে, ব্যক্তি প্রথমে ওষুধ বা স্যালাইন খেয়ে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ডায়রিয়া বন্ধ করার ঘরোয়া প্রতিকারও ডায়রিয়াকে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ডায়রিয়া কি?
মলদ্বার থেকে পানির মতো ঘন ঘন মল বের হওয়াকে ডায়রিয়া বলে। অনেক কারণে ডায়রিয়া হতে পারে। শরীরে উপস্থিত প্রধানত বাত, পিত্ত, কফ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে শরীরের পরিপাকতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অবস্খায় খাবার ভালোভাবে হজম হয় না এবং অপাচ্য খাবার পাতলা হয়ে মল দিয়ে বার বার বের হতে হতে ফেনাযুক্ত হয়ে যায়।
Contents
ডায়রিয়া বা লুজ মোশনের কারণ
- অস্বাস্থ্যকর খাবার বা দূষিত পানি খেলে পরিপাকতন্ত্রে সংক্রমণ হলে ডায়রিয়ার সমস্যা হয়।
- রাতে অবশিষ্ট বাসি খাবার খেলে ডায়রিয়া হতে পারে।
- অতিরিক্ত তৈলাক্ত জিনিস যেমন- সমোসা, পিৎজা, বার্গার ইত্যাদি এবং ময়দা ও বেসন দিয়ে তৈরি জিনিস খাওয়ার কারণেও ডায়রিয়া হতে পারে।
- মানসিক চাপ, শোক বা ভয়ের কারণেও ডায়রিয়া হয়।
- দীর্ঘক্ষণ মল ধরে রাখলে ডায়রিয়া হয়।
- অতিরিক্ত দূষিত অ্যালকোহল গ্রহণ করলে ডায়রিয়া হতে পারে।
- একই পরিমাণের বেশি পানি পান করলে ডায়রিয়া হতে পারে।
- অতিরিক্ত তৈলাক্ত, মশলাদার খাবার খেলে ডায়রিয়া হতে পারে।
- প্রচুর মিষ্টি পনির খাওয়ার ফলে ডায়রিয়া হতে পারে।
ছোট বাচ্চাদের ডায়রিয়া হয় কেন?
ছোট বাচ্চাদের ডায়রিয়া হওয়ার অনেক কারণ আছে, যেগুলো হল:-
১. ছোট শিশুরা মায়ের দুধ পান করে, এমন অবস্থায় মায়ের দুধ কোনো কারণে দূষিত হলে শিশুর ডায়রিয়া হয়।
২. অনেক সময় দেখা গেছে মায়েরা বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় নিজের খাবার ও পানীয়তে খুব বেশি নজর রাখে না। তারা বেশি তেল, মরিচ-মশলা দিয়ে খাবার খায়, এমনকি রাতে রাখা বাসি খাবারও খায়। এর ফলে শরীরে উপস্থিত ভারসাম্যহীন বাত-পিত্ত-কফ হয়ে মায়ের দুধকে দূষিত করে। এতে শিশুদের ডায়রিয়া হয়।
৩. শিশুর দুধের বোতল সঠিকভাবে পরিষ্কার না করলে বোতল সংক্রমিত হয়, যার কারণে শিশুদের ডায়রিয়া শুরু হয়।
একইভাবে শিশুরা বাড়ির বাইরের খাবার যেমন পিৎজা, বার্গার, পেস্ট্রি, আইসক্রিম ইত্যাদি বেশি খায়। এটি ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে।
অনেক সময় শিশুরা সংক্রমিত পানি পান করে, হাত না ধুয়ে খাবার খায়। পরিমিত পরিমাণে জল পান করে না। এই সব কারণে শিশুদের ডায়রিয়া হয়। লক্ষণীয় যে, সঠিক উপায়ে এবং সময়মতো চিকিৎসা না করালে শিশুরাও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে।
ডায়রিয়া দ্বারা সৃষ্ট অন্যান্য রোগ
ডায়রিয়া হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। সময়মতো চিকিৎসা না করলে ডায়রিয়া মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে:-
ত্বকে বলিরেখা- ডায়রিয়া বন্ধ না হলে শরীরে পানির অভাব হয়, যার কারণে চোখের নিচে কালো দাগ দেখা দিতে শুরু করে। ত্বকে বলিরেখা দেখা দেয়। তাই ডায়রিয়া বন্ধ করার ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন হোন।
আরো পড়ুনঃ মুখের বলিরেখা দূর করার উপায়
শরীরে পানি কমে যাওয়া– ডায়রিয়ার কারণে শরীরে পানি কমে যায়। এ কারণে রোগী খুব তৃষ্ণার্ত বোধ করে। গলা শুকিয়ে যেতে থাকে। এ কারণে রোগী পানিশূন্যতা রোগের শিকার হয়। এর ফলে শরীরে উপস্থিত উপাদানসমূহ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, শরীরকে দুর্বল করে দেয় এবং পেটে ব্যথা হয়। এই ডায়রিয়া আমাশয়ে রূপ নেয়।
বমি হওয়া– ডায়রিয়া বেশিক্ষণ না থামলে পেটে গ্যাস তৈরি হতে থাকে। এ কারণে রোগীর বমিও শুরু হয়।
রক্তশূন্যতার সম্ভাবনা– কোন রোগীর আগে থেকে রক্তশূন্যতা থাকলে, ডায়রিয়ার কারণে আরও রক্তস্বল্পতা হতে পারে।
শ্বাসকষ্ট– অনেক সময় ঘন ঘন মলত্যাগের কারণে রোগী দুর্বল বোধ করতে থাকে। রোগীর হাঁটতে সমস্যা শুরু হয় এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
জ্বর – ডায়রিয়ার কারণে সারা শরীরে ব্যথা শুরু হয়, ক্ষুধা থাকে না। হাত পায়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। তাই রোগী দুর্বল হতে থাকে। এ কারণে জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন অবস্থায় হৃৎপিণ্ড, নাভি ও শ্রোণীতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
ডায়রিয়ার ঘরোয়া প্রতিকার-
ডায়রিয়া বন্ধ করতে ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে আপনি এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে দেখতে পারেন:-
ধনিয়ার ব্যবহার-
অতিরিক্ত ডায়রিয়ার কারণে রোগীর তৃষ্ণা বেশি লাগে। এমন অবস্থায় ১ লিটার পানিতে ১ চা চামচ শুকনো ধনে সিদ্ধ করুন। অর্ধেক পানি অবশিষ্ট থাকলে পানি ছেঁকে ঠান্ডা করুন। এটি রোগীকে অল্প পরিমাণে দিতে হবে।
কাচনার ব্যবহার-
কাচনার ফুলের ২-৩ টি কুঁড়ি নিন এবং ভাল করে পিষে নিন। চিনির সিরাপের সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় ২-৩ বার খাওয়ার আগে বা পরে খান। এর ফলে ঘন ঘন ডায়রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
লেবু–
১ কাপ বিশুদ্ধ পানিতে ১ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। এটি প্রতিদিন সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা খালি পেটে বা খাবারের পর খান। এটি ধীরে ধীরে অন্ত্র পরিষ্কার করে। যাদের ডায়রিয়ার সাথে বমি শুরু হয় তাদের ক্ষেত্রে এই রেসিপিটি খুবই কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে।
জিরা- আধা চা চামচ ভাজা জিরার গুঁড়ার সাথে ১ কাপ দই বা ঘোল মিশিয়ে নিন। এটি খেলে ডায়রিয়ায় উপকার পাওয়া যায়।
মৌরি বীজ-
১ চামচ কাঁচা মৌরি এবং ১ চামচ রান্না করা ভাজা মৌরি নিয়ে মেশান। এটি আধা চা-চামচ করে সকালে ও সন্ধ্যায় রোগীকে দিন। এই প্রতিকারটি ডায়রিয়ায় খুবই উপকারী।
বেল ফল- ১ চা চামচ পাকা বেলের পাল্প ১ কাপ তাজা দই মিশিয়ে খেলে ডায়রিয়ায় উপকার পাওয়া যায়।
কাঁচা পেঁপের ব্যবহার- কাঁচা পেঁপে ৪-৫ টুকরা সিদ্ধ করে খান, পুরানো ডায়রিয়া সেরে যাবে।
অন্যান্য ঘরোয়া প্রতিকার–
জাম ও আমের গুঁড়ো আধা চা-চামচ ভাজা মাইরোবালা দিয়ে খেলে ডায়রিয়ায় দ্রুত উপশম হয়।
১ গ্লাস পানিতে ১ চা চামচ চিনি, ১ চা চামচ লবণ এবং ১ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে একটি দ্রবণ তৈরি করুন। এই দ্রবণটি প্রতি দুই বা তিন ঘন্টা পর পর রোগীকে দিতে হবে। এটি ডায়রিয়া বন্ধ করার একটি কার্যকর উপায়।
রামবনের রস – ২৫০ মিলিগ্রাম, পীযূষবল্লীরাস – ১২৫ মিলিগ্রাম, সঞ্জীবনী বটি – ২০ গ্রাম এবং দদিমাষ্টক পাউডার – ২৫০ মিলিগ্রাম, একসাথে ভালো করে মেশান। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে আধা চা চামচ মধু দিয়ে খান। ডায়াবেটিস রোগী হলে এই পাউডারটি হালকা গরম পানিতে দিয়ে খেতে হবে।
কুটজারিশতা – ২০ মিলি অথবা ২ চা-চামচ/সমান অংশ, জিরকাদিরিষ্ট- ২০ মিলি ২ চা-চামচ পানির সাথে মিশিয়ে সকাল-সন্ধ্যা নাস্তা ও খাবারের পর দিতে হবে।
৫০ গ্রাম বিল্বের গুঁড়ো, ৫০ গ্রাম গঙ্গাধরের গুঁড়ো, ৫ গ্রাম শঙ্খের খোসা, ৫ গ্রাম কর্পদক ভস্ম নিন। এই সব একসাথে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় খালি পেটে আধা চা-চামচ খেলে ডায়রিয়ায় খুব দ্রুত উপশম হয়
নাগর, আতাবিশা, মুস্তা এবং শুকনো ধনে নিন। এই সব গুঁড়ো ১ লিটার পানি দিয়ে ফুটিয়ে নিন। ক্বাথ অর্ধেক থেকে গেলে ছাঁকুন এবং ঠান্ডা করার পর রোগীকে দিন। এই ক্বাথ ডায়রিয়া কমায় এবং রোগী ক্ষুধার্ত বোধ করতে শুরু করে।
ডায়রিয়া কমতে শুরু করলে শুঁথি, মারিচ, গোলমরিচ, আতিস, শিংগুর সমপরিমাণ গুঁড়ো মিশিয়ে খেতে হবে। এটি পরিপাকতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। এতে ক্ষুধা বাড়ে।
ডায়রিয়ার সময় আপনার জীবনধারা
ডায়রিয়ার সময়, একজন ব্যক্তির তার জীবনধারায় নিম্নলিখিত পরিবর্তন করা উচিত:-
- রোগীকে সর্বোচ্চ বিশ্রাম নিতে হবে, কারণ অতিরিক্ত ডায়রিয়ার কারণে শরীরে দুর্বলতা আসে।
- ভালো করে হাত ধুয়ে খেয়ে নিন।
- বেশিক্ষণ ক্ষুধার্ত থাকা উচিত নয়। খাবার সময়মতো খেতে হবে।
- খাবার খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটুন যাতে খাবার ঠিকমতো হজম হয়।
- রাতে সময়মতো ঘুমানো উচিত।
- কোন শারীরিক ব্যায়াম করা উচিত নয়।
- ধূমপান করা উচিত নয়।
- যৌনতা বা রাগ করা উচিত নয়।
ডায়রিয়ার সময় আপনার ডায়েট
ডায়রিয়ার সময় একজন ব্যক্তির খাদ্য এইরকম হওয়া উচিত:-
মল পানির মতো পাতলা হলে রোগীকে মসুর ডালের স্যুপ দিতে হবে। রোগীকে মুগ ডাল, মসুর ডালের স্যুপ, ঘোল, দই, মুগ খিচড়ি, দই, লাউ , পরওয়াল , তেলবিহীন খাবার খেতে হবে। মসুর ডালের স্যুপে শুকনো আদা, কালো গোলমরিচ, পিপলির গুঁড়া মিশিয়ে নিতে হবে। এরা পাচনতন্ত্রকে শক্তিশালী করে (Appetite) ক্ষুধা বাড়ায়।
বাইরের খাবার যেমন পিৎজা, বার্গার, পেস্ট্রি, তৈলাক্ত খাবার, মরিচ-মসলাযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া উচিত নয়।
পানি ফুটিয়ে, ফিল্টার করে পান করতে হবে।
রাতে রাখা বাসি খাবার খাওয়া উচিত নয়।
সকালে পুষ্টিকর খাবার যেমন পোরিজ ইত্যাদি খেতে হবে।
মটর, উরদের ডাল, কাঁঠাল, শসা, ক্ষীর, সমোসা, পুরি, বেসন এবং আটা দিয়ে তৈরি জিনিস খাওয়া উচিত নয়।
কোমল পানীয় বা অ্যালকোহল খাওয়া উচিত নয়।
ডায়রিয়ার সময় বাচ্চাদের ডায়েট
যখন একটি শিশুর ডায়রিয়া হয়, তখন তাকে এই জাতীয় খাবার দিতে হবে –
শিশুর বয়স ৬-৭ মাস হলে তাকে খাবার এর আকারে ফলের রস, বরফ, মুগ ডালের খিচুড়ি, স্যুপ ইত্যাদি দিতে হবে।
তাজা ফলের রস দিতে হবে।
শিশুকে অল্প সময়ে বাটারমিল্ক (ঘোল), ভাতের পানি, সবুজ সবজির স্যুপ দিতে হবে, যাতে শরীরে পানির অভাব পূরণ হয়।
ওআরএস (ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন) পাউডার দিয়ে দ্রবণ তৈরি করে শিশুকে দিন। ১ লিটার জল সিদ্ধ করে ফিল্টার করুন এবং ঠান্ডা করুন। এটি ওয়ারএস প্যাকেট খুলে মিশিয়ে নিন। আধা ঘণ্টার মধ্যে অল্প পরিমাণে বাচ্চাকে দিন। এটি ব্যবহারে শরীরে পানি ও লবণের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং শিশুর ক্ষুধাও বৃদ্ধি পায়।
ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে শিশুদের জীবনধারা এমন হওয়া উচিত–
- শিশুদের বাইরের খাবার দেওয়া উচিত নয় এবং পরিষ্কার হাতে পানীয় জল দেওয়া উচিত।
- শিশুদের খেলনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- শিশুকে নোংরা হাত, নোংরা কাপড় বা খেলনা মুখে নিতে দেবেন না।
- শিশুর ডায়রিয়া হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
যদি একজন ব্যক্তি এই উল্লেখিত প্রেসক্রিপশন বা ওষুধ থেকে উপকৃত না হন, তাহলে এর অনেক কারণ থাকতে পারে যেমন-
- রোগী ওষুধ খাচ্ছেন কিন্তু পরিহার করছেন না, যেমন ভারী খাবার (তেল, মরিচ, মশলা সহ) খাওয়া।
- স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাবার খাওয়া।
- অত্যধিক পানি পান করা, বা সিদ্ধ করা পানি পান না করা।
- গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকার কারণে শরীর ভারসাম্যহীন থাকে, যার কারণে রোগীর ওপর প্রতিকারের কোনো প্রভাব পড়ে না।
- নির্ধারিত সময়ে ওষুধ না খেলে কোন প্রতিকার সাহায্য করে না।
আরো পড়ুনঃ