মানব কল্যাণে বিজ্ঞান রচনা
স্কুল কলেজের নানান পরীক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা হলো মানব কল্যাণে বিজ্ঞান, দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান ইত্যাদি নামে বিজ্ঞান নিয়ে রচনা। তাই আপনাদের সুবিধার্থে আজকে মানব কল্যাণে বিজ্ঞান নিয়ে একটি রচনা দেওয়া হলো-
মানব কল্যাণে বিজ্ঞান রচনা
ভূমিকাঃ বিজ্ঞান! বর্তমান যুগে চারিদিক মুখরিত হয়ে আছে বিজ্ঞানের বৈপ্লবিক জয়যাত্রায়। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে কল্পনাতীত অগ্রযাত্রার গতি। মানব সভ্যতার প্রায় সকল ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের জাদুকরি স্পর্শ জীবনকে করেছে সুখ-শান্তিতে সমৃদ্ধ। মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের ব্যাপক অবদান দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই অনুভব করা যায়।
বিজ্ঞানের ধারণাঃ বিজ্ঞান হল বিশেষ জ্ঞান। মনীষীদের মতে বিজ্ঞান হলো সুশৃংখল ও সুসংবদ্ধ জ্ঞান। অনুসন্ধান প্রিয় মানুষের বস্তু জগত সম্পর্কে ধারণা এবং বিচিত্র কৌশলে তার উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা থেকেই বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়েছে। মানুষের প্রয়োজন মেটানোর তারানা থেকেই তৈরি হয়েছে বিজ্ঞান। ক্রমে সভ্যতার বিকাশের সহায়ক শক্তি হিসেবে মানুষের জীবনের সঙ্গে একাত্ম্য হয়ে গেছে বিজ্ঞান।
বিজ্ঞানের কল্যাণ ধর্মী অবদানঃ সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষের প্রয়োজন উদ্ভাবনের প্রেরণা যোগায়। বর্তমানে বিজ্ঞানের সহযোগিতায় মানুষ জলস্থল, অন্তরীক্ষ জয় করেছে। সংকট নিরসন অসুখ সারস্বন্দ বিধানের জন্য বহু অভাবনীয় কৌশল আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞান। মানব জীবনে বিজ্ঞানের সুগভীর প্রভাবের সাথে বিস্ময়কর আবিষ্কার চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। বিজ্ঞানের কর্ম সাধনার ফলেই আমরা পেয়েছি আজকের এই আধুনিক সভ্যতা। মানুষ আজ আকাশ পাতাল কে সাজিয়েছে নিজের পরিকল্পনার সাজে। মানব সভ্যতায় বিজ্ঞান এনেছে যুগান্তর, দূর কে করেছে আপন আর জীবনকে করেছে সহজ। সমাজ, দেশ, পৃথিবী এবং ব্যক্তিগত জীবন সর্ব ক্ষেত্রেই রয়েছে বিজ্ঞানের কল্যাণ ধর্মী অবদান।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানঃ মানবসমাজের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান এনে দিয়েছে সাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশ। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিক বাতি ও পাখা, আয়রন মেশিন, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, হিটার, ব্লেন্ডার, ফ্রিজ, কুকার ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে আমাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত সহজ আরামদায়ক হয়ে উঠেছে। তথ্যভিত্তিক এ যুগে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কম্পিউটার, ফটোস্ট্যাট মেশিন, ফেক্স ইত্যাদি যন্ত্রপাতি। বিজ্ঞান এভাবেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সকল প্রয়োজন মেটানোর জন্যই কাজ করে যাচ্ছে।
গ্রামীণ জীবনে বিজ্ঞানঃ বিজ্ঞানভিত্তিক প্রভাবে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলার গ্রামীণ জীবনের অবস্থা। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই গ্রামাঞ্চল এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় মগ্ন। সকালে আরামদায়ক বিছানা থেকে এলাম ঘড়ির শব্দে ঘুম থেকে উঠা। ফ্রেশ হওয়ার জন্য পেস্ট ও ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজা থেকে শুরু করে গ্যাসের চুলায় রান্না করা, কর্মস্থলে যেতে যানবাহন ব্যবহার, অফিসে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার, নিজেকে আরাম দেওয়ার জন্য ফ্যান বা এসির নিচে অবস্থান, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা, রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘরে অবস্থান, বিনোদনের জন্য টিভি, স্মার্টফোন ব্যবহার ও সর্বশেষ আরামদায়ক বিছানায় ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের ছোঁয়া রয়েছে। বিজ্ঞান গ্রামীন জীবনকে করেছে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দের ও সুখ-শান্তির।
কায়িকশ্রম লাঘবে বিজ্ঞানঃ বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে কমেছে কায়িক শ্রমের ব্যবহার। প্রযুক্তিনির্ভর ভাবেই করা হচ্ছে এখন সকল ধরনের কষ্টের কাজ। বিশেষ করে কনস্ট্রাকশন, ফ্যাক্টরি কাজ, ভারী কিছু উত্তোলন ইত্যাদি সকল কাজেই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রযুক্তি। ক্রেন ব্যবহার করা হচ্ছে মাটি-কাটা, ভারী বস্তু উত্তোলনের জন্য। কনস্ট্রাকশন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে নানা ধরনের উন্নত মেশিন। ফ্যাক্টরিতে বিপদজনক কাজগুলো এখন করা হয় রোবটিক মেশিন দিয়ে। রান্নাবান্নায় ব্যবহৃত হয় গ্যাস, কুকার, ওভেন ইত্যাদি। হাতে লেখার বিপরীতে এসেছে কম্পিউটার টাইপিং। সর্বক্ষেত্রেই শারীরিক শ্রমকে লাঘব করছে বিজ্ঞান।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞানঃ জাতি গঠনের মূল উপাদান শিক্ষা, আর শিক্ষা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রভাব বর্তমানে অতুলনীয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছে বিদ্যুৎ, যা বিজ্ঞানের অনেক বড় একটি অবদান। এছাড়াও বর্তমানে তথ্যভিত্তিক এ যুগে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করে পাওয়া যাচ্ছে শিক্ষার নানা তথ্য। একটা শিক্ষিত সমাজই পরবর্তীতে বিজ্ঞানকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। তাই বর্তমানে অনলাইন ক্লাস, প্রযুক্তি শিক্ষাসহ শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেকটাই লক্ষনীয় প্রভাব ফেলে বিজ্ঞানের প্রযুক্তি।
চিকিৎসায় বিজ্ঞানঃ চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ আজ অকাল মৃত্যু থেকে রক্ষা পাচ্ছে। কলেরা, বসন্ত, যক্ষা, ক্যান্সার ইত্যাদি মরণব্যাধির চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানের সাহায্যেই। অস্ত্রোপাচার ব্যবস্থা, এক্সরে, আল্ট্রাভায়োলেট-রে, অণুবীক্ষণ যন্ত্র, সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, বিভিন্ন রোগ পরীক্ষণ মেশিন, উন্নতমানের ঔষধ ও কম্পিউটার কেন্দ্রিক টেলিমেডিসিন পদ্ধতির ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ হয়ে উঠেছে মানব সভ্যতার জন্য কল্যাণকর।
বিনোদন ক্ষেত্রে বিজ্ঞানঃ বর্তমানে বিনোদন মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। এ বিনোদনকে আরো বেশি রোমাঞ্চকর করে তুলতে প্রতিনিয়তই বিজ্ঞান আবিষ্কার করছে নতুন নতুন মঞ্চ। বর্তমানে ভিডিও অ্যানিমেশন আমাদের কৌতূহলকে অনেকটাই উদ্দীপ্ত করে। থ্রিডি অ্যানিমেশন, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, বিভিন্ন ভিডিও গেমস ও বিনোদনমূলক প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে অনেকটাই আনন্দদায়ক করে তুলেছে।
কৃষি কাজে বিজ্ঞানঃ জীবনধারণের মূল উপাদান পাওয়া যায় কৃষিকাজ থেকেই। কৃষিকে যুগোপযোগী ও সহজ করে তুলেছে বিজ্ঞান। প্রাচীন ভূতা লাঙলের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত মানের ট্রাক্টর। ফসল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক, সার, মোটর চালিত সেচব্যবস্থা, ধান ভাঙ্গানোর মেশিন, বীজ বপন মেশিন, ফসল কাটার মেশিন, উন্নত জাতের বীজ গবেষণা করে উদ্বোধন, গবাদি পশু পালনের জন্য প্রযুক্তি নির্ভর ঘাস কাটার মেশিন, মুরগির ডিম ফুটানোর জন্য ইনকিউবেটর ইত্যাদি প্রযুক্তির প্রভাবে কৃষি কাজ হয়ে উঠেছে সহজ। ফসলের অধিক উৎপাদন কৃষকের মুখে ফুটিয়েছে হাসি।
শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞানঃ পূর্বে মানুষ যেকোনো ধরনের উৎপাদনের ক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল। তবে বর্তমানে উৎপাদনে সর্বক্ষেত্রেই বিরাজ করছে প্রযুক্তির আধিপত্য। তাই মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে স্বস্তি ও আয়াসপূর্ণ। শত মানুষের পরিশ্রমেও যেটি একসময় সম্ভব ছিল না তা আজ প্রযুক্তিগত যন্ত্রের কয়েকটি বোতাম টিপেই মুহূর্তের মধ্যে সম্পন্ন করা যায়।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানঃ বর্তমানে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবেই বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। আধুনিক কনকর্ড বিমান, রেলপথ, বুলেট ট্রেন, এরোপ্লেন, হেলিকপ্টার, বাস এমনকি সাইকেল পর্যন্ত বিজ্ঞানের অবদান। তাছাড়া মোবাইলে কথা বলা, ছবি পাঠানো ও দুরদূরান্তে থেকেও ভিডিও কলে কথা বলা যায় বিজ্ঞানের ব্যবহারে।
প্রকৃতির উপকারে বিজ্ঞানঃ বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে প্রকৃতির উপকারেও তা ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা, ভূপ্রকৃতির অবস্থা, সামুদ্রিক অবস্থা জানা যায়। উইন্ডমিলের মাধ্যমে বাতাস থেকে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। প্রকৃতির নানা বিপদজনক বিষয়গুলো ব্যবহার করে মানুষ উদ্ভাবন করছে নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি।
বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাঃ সমগ্র বিশ্বেই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী এই বিজ্ঞান। আধুনিক সভ্য সমাজে চলতে গেলে অবশ্যই বিজ্ঞান শিক্ষা অর্জন করতে হবে। এছাড়াও একটি বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষিত সমাজই পরবর্তীতে বিজ্ঞানকে আরো আধুনিকায়ন করতে পারবে। তাই বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।
বিজ্ঞানের অপব্যবহারঃ বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণ সাধনের পাশাপাশি জীবনে এনে দিয়েছে বিভীষিকা। যন্ত্রের উপর নির্ভর হচ্ছে মানুষ, বাড়ছে কর্মবিমুখতা। সমাজের মানুষকে করে তুলেছে অলস। অন্যদিকে, মানুষের কর্মক্ষেত্রের রাজত্ব করছে প্রযুক্তি। ফলে বেকারত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিনামাইট, বোমারু বিমান, সাবমেরিন, ট্যাংক, রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্র পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে, ইন্টারনেট, মোবাইল-কম্পিউটার অপব্যবহারের ফলে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে প্রতিনিয়তই।
উপসংহারঃ সভ্যতার বিকাশ সাধনের মূলে রয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান আমাদের জীবনে সুখ সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে, জীবনকে করেছে গতিময়। বিজ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে মানব সভ্যতা হবে আরো উন্নত।