বিজ্ঞান

স্পুটনিক-৫ঃ রাশিয়ার তৈরি ভ্যাকসিন

স্পুটনিক-৫ নামে রাশিয়া পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে করোনাভাইরসের একটি ভ্যাকসিনের নিবন্ধন করিয়েছে গেলো মজ্ঞলবার। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মন্ত্রীসভার সাথে এক ভিডিও কনফারেন্সে এই তথ্য নিশ্চিত করে। কিন্তু তার পরেই এই ভ্যাকসিনের পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে গেছে পৃথিবী। কিন্তু কেন? জানবো একে একে সবই।

গেলো কয়েক মাস ধরে পুরো পৃথিবী কোভিড-১৯ নামক এক অতি ক্ষুদ্র ভাইরাসের আক্রমনে ধুঁকছে। আক্রান্ত ২ কোটিরও বেশি মানুষ যেখানে মৃতের সংখ্যা দাড়িয়েছে সাড়ে ৭ লক্ষ। প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। কোন কিছুই আটকাতে পারছেনা এই ভাইরাসের সংক্রমন। 

কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এখন পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের আশা ভরসা ভ্যাকসিন। কিন্তু কবে আসবে ভ্যাকসিন? বা আদৌ আসবে কি না ভ্যাকসিন সেটাও কেও জানে না। কিন্তু তাই বলে কি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায়?

তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জোড়েসোড়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার মতে প্রায় ১৭০টির বেশি ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ চলমান আছে।

যার মধ্যে ১৩৯টি উদ্যোগ প্রাক ক্লিনিকাল পর্যায়ে আছে। ২৫টি টিকা রয়েছে মানব শরীরে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর প্রথম ধাপে। দ্বিতীয় ধাপে পা রেখেছে ১৭টি টিকা। আর ৩য় ও সর্বশেষ ধাপে পৌছাতে পেরেছে মাত্র ৬টি টিকা। যার মধ্যে সবচাইতে এগিয়ে আছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন। যার শেষ ট্রায়াল দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে চলমান। 

এরই মাঝে গত ১১ই আগস্ট ধুঁকতে থাকা পৃথিবীকে এক সুখবর দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মন্ত্রিপরিষদের সাথে এক ভিডিও কনফারেন্সে পুতিন দাবি করেছেন “মস্কোর গামেলেয়া ইনস্টিটিউট কোভিড-১৯ এর প্রথম ভ্যাকসিন নিবন্ধন করেছে। তাদের এই ভ্যাকসিন সকল ধাপ সফল ভাবে পার করেছে এবং ভ্যাকসিন নিয়েছেন খোদ পুতিন কন্যা”।

করোনাভাইরাস এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে এই দুইটি পোস্ট পড়তে পারেনঃ

তার এই ঘোষণার পর প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায় কোভিড-১৯ এ জর্জরিত পৃথিবীর বুকে। সবার মনে উঁকি দেয় আশার আলো। তাহলে বুঝি অবশেষে শেষ হচ্ছে কোভিড-১৯ এর দৌরাত্ম। পৃথিবী বুঝি আবার তার কর্মচঞ্চল চেনা রূপে ফিরে আসবে। এই আশা নিয়ে যখন বুক বাঁধছিল সাধারণ মানুষ ঠিক তখনই বিজ্ঞানী মহল থেকে ভেসে আসে সমালোচনার ঝড়। 

কিন্তু কেন এই সমালোচনা? রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে কেনো সন্দেহ? এর পিছনে কি কাজ করছে কোন রাজনৈতিক কারণ? একে একে জানবো সবগুলো প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু তার আগে এক নজরে দেখে নিবো রাশিয়ার গামেলেয়া ইনস্টিটিউট থেকে যে ভ্যাকসিন নিবন্ধিত হয়েছে তার সম্পর্কে বিস্তারিত।

স্পুটনিক-৫ নামকরণ ও রহস্য

রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিন এর নাম দিয়েছে “স্পুটনিক ৫ (Sputnik V)”। এই নামকরণের পিছনের কারণ জানতে হলে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক ১ মহাকাশে প্রেরণ করে। যা স্নায়ু যুদ্ধের সময়কার এক উল্ল্যেখ যোগ্য ঘটনা। 

তারই প্রেক্ষাপটে রাশিয়া এই ভ্যাকসিনের নাম দেয় “স্পুটনিক ৫”। কারণ এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে এক শীতল যুদ্ধ চলছে। কে কার আগে ভ্যাকসিন আনতে পারবে সেই দৌড়ে রয়েছে পৃথিবীর প্রায় সকল ক্ষমতাধর রাষ্ট্র।

কিন্তু সবার আগে বাজিমাত করেছে রাশিয়া, সবার আগে ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছে। তাই পুরনো ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিতেই এর নামকরণ করা হয়েছে “স্পুটনিক ৫”।

কিভাবে কাজ করে স্পুটনিক-৫ ?

SARS-COV-2 টাইপের অপেক্ষাকৃত দুর্বল এডেনো ভাইরাসের ডিএনএ এর ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে এই ভ্যাকসিন। যেটি কোভিড-১৯ এর সমগোত্রীয়। এই ভ্যাকসিন শরীরে প্রবেশ করার পরে দুর্বল ভাইরাসের কিছু নিষ্প্রান কণা বা পার্টিকলস তৈরি করবে যার ফলে শরীরের কোভিড-১৯ এর এন্টিবডি তৈরি হবে।

মস্কোর গামেলেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর আলেকজান্ডার গিন্টসবার্গ জানিয়েছেন, ভ্যাকসিনের কারণে শরীরে যে পার্টিকলস তৈরি হবে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। হালকা একটু জ্বর হলেও হতে পারে যা সাধারণ প্যারাসিটামল খেলেই চলে যাবে।

সেখান থেকে আরো জানানো হয়েছে যে এই ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা ২ বছর। অর্থার ২ বছর পর পর এই টিকা একজন ব্যাক্তিকে নিতে হবে।

কারা পাবে এই ভ্যাকসিন?

রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় জানিয়েছে স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, পুলিশ, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অর্থাৎ যারা সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছেন, তারাই সবার আগে এই ভ্যাকসিন নেয়ার সুযোগ পাবেন৷

কবে থেকে পাওয়া যাবে এই ভ্যাকসিন?

আগামী অক্টোবর থেকে ব্যাপক পরিসরে ভ্যাকসিন উৎপাদনের কাজ শুরু করবে রাশিয়ে বলে জানানো হয়েছে রাশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। 

ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দেবার পরপরই ভারত-সহ ২০টি দেশ থেকে ১ বিলিয়ন ডোজের অর্ডার পেয়েছে রাশিয়া।

কেন স্পুটনিক-৫ নিয়ে সমালোচনা?

গেলো মঙ্গলবার পুতিন ভিডিও কনফারেন্সে ভ্যাকসিন নিবন্ধনের ঘোষণা দেবার পরপরই উঠেছে সমালোচনার ঝড়। বিজ্ঞানীমহলে দানা বেধেছে সন্দেহ। কিন্তু কেন? এই বিষয়টা আমি ধাপে ধাপে বলার চেষ্টা করবো। তাহলে চলুন দেখে আসি কেনো রাশিয়ার ভ্যাকসিনের প্রতি সন্দেহ পোষণ করছে বিজ্ঞানীরা।

একটা ভ্যাকসিন বাজারে আসার আগে তাকে কয়েক ধাপের পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় যেখানে কোন প্রকার ছাড় দেওয়া প্রায় অসম্ভব। যেকোন ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রবেশ করানোর পূর্বে তা নিরাপদ ও কার্যকর কি না তা যাচাই বাছাই করে দেখা হয়। আর এটা করার জন্য ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণাকারি প্রতিষ্ঠানকে তাদের সকল তথ্য জার্নালে প্রকাশ করতে হয়।

যাতে করে বিশ্বের অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এর সকল তথ্য যাচাই বাছাই করে দেখতে পারে যে ভ্যাকসিনে কোথাও কোন ত্রুটি আছে কি না। এতে করে ভ্যাকসিনটি মানবদেহের জন্য নিরাপদ কি না সেই সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ার ফলে ভ্যাকসিনটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু রাশিয়া তাদের গবেষণার কোন তথ্য জার্নালে প্রকাশ করেনি

যে কোন ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেবার আগে মানবদেহে তিনটি ধাপে পরীক্ষা করে দেখা হয় যে ভ্যাকসিনটি মানবদেহে কার্যকর কি না। 

১ম ধাপে সীমিত সংখ্যাক মানুষের উপর প্রয়োগ করে দেখা হয় প্রাক ক্লিনিক্যাল ট্রায়লে ভ্যাকসিনটি পশুর দেহে যেভাবে পতিক্রিয়া পাওয়া গেছে সেই একই পতিক্রিয়া মানব দেহে পাওয়া যায় কি না।

২য় ধাপে দেখা হয় ভ্যাকসিনটা কতটা নিরাপদ ও তা মানব দেহে কি মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। এই ধাপে কয়েক শত মানুষের উপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়।

৩য় ধাপটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এই ধাপে হাজার হাজার মানুষের উপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করে বিজ্ঞানীরা মানব দেহে এর কোন প্বার্শপতিক্রিয়া আছে কি না সেটা খুজে বের করার চেষ্টা করেন। তাছাড়া এই ধাপে বিভিন্ন বয়সের মানুষ এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষকে এই ভ্যাকসিনটি দেওয়া হয়।

কিন্তু রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি প্রথম দুই ধাপ পার করতে পারলেও ৩য় ধাপ পার করার আগেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে যদিও দাবি করা হয়েছে তারা হাজার কয়েক লোকের উপর পরীক্ষা করে দেখেছে। কিন্তু এই সম্পর্কে কোন রিপোর্ট প্রকাশ করেনি রাশিয়া।

স্বয়ং রাশিয়ার মস্কোভিত্তিক অ্যাসোাসিয়েশন অফ ক্লিনিকাল ট্রায়ালস অর্গানাইজেশন (ACTO) চলতি সপ্তাহেই স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়কে অনুরোধ করেছিল, এই ভ্যাকসিন নিয়ে তাড়াহুড়ো না করতে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো রাশিয়ার ভ্যাকসিন “স্পুটনিক ৫” কে অনুমোদন দেয় নি। কানাডা সরাসরি এই ভ্যাকসিন নিতে অস্বীকার করেছে।

এবার অনেকের মনেই প্রশ্ন আসে রাশিয়ার এই তাড়াহুড়ো করে ভ্যাকসিন  অনুমোদন দেবার পেছনে কোন রাজনৈতিক মার প্যাচ নেই তো?

থাকতেই পারে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে প্রথম হলে রাজনৈতিক সমীকরণে পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। আর সেই প্রতিযোগীতার ঘোড়া যখন চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির মত দেশ তখন মনে সন্দেহ জাগতেই পারে।

তবে যাই হোক, আমরা আশা করবো রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক ভাবে নিরাপদ এবং কার্যকর প্রমান করেই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করবে। তাড়াহুড়ো করে কোটি কোটি মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কখনোই আমাদের কাম্য নয়।

যে ছয়টি ভ্যাকসিন ৩য় ধাপে আছে আশা করি সেগুলোর মধ্য থেকে কোন একটা সফল হবে এবং মানবজাতিকে করোনাভাইরসের প্রকোপ থেকে উদ্ধার করবে। ছাত্রদের জন্য অনলাইনে আয় করার উপায় এবং ফ্রিল্যান্সিং কিভাবে শিখবো কমপ্লিট গাইডলাইন দেওয়া আছে এই পোস্ট দুটি দেখে নিন। জমির পরিমাপ সম্পর্কে আমাদের ওয়েবসাইটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্ট দেওয়া আছে এটিও এখনই দেখে নিন।

5/5 - (9 votes)

Admin at Shopnik.com.bd

As the driving force behind Shopnik.com.bd, the Admin is dedicated to providing readers with insightful and informative blogs across a wide range of topics. From expert reviews on the latest products to engaging articles from anonymous contributors, the Admin ensures that every post is designed to inform, inspire, and engage. Whether it's tech, lifestyle, or the latest trends, Shopnik.com.bd is your go-to source for up-to-date information and valuable content.

One Comment

  1. আশা করি রাশিয়ার এই ভ্যাকসিন সফল হবে। এবং মানবজাতি এই ভয়ংকর সময় থেকে বের হয়ে আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button