স্বাস্থ্য

সর্পগন্ধার উপকারিতা ও ব্যবহার

কথিত আছে সাপে কামড়ালে বিষের আগেই ভয়ে মানুষ মারা যায়, কিন্তু সর্পগন্ধার ব্যবহার জানলে ভয়ে মরবে না বিষে। সর্পগন্ধার ভেষজ গুণ সাপের বিষ দূর করার একটি ভালো ওষুধ। সর্পগন্ধা নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে। উদাহরণস্বরূপ, বলা হয় যে একটি কোবরার সাথে লড়াই করার আগে, বেজি সর্পগন্ধার পাতার রস চুষে খায়। আগে একে পাগলের ওষুধও বলা হত কারণ সর্পগন্ধার ব্যবহারে পাগলামিও নিরাময় হয়।

সর্পগন্ধা কি?

সর্পগন্ধা উদ্ভিদের বোটানিক্যাল অর্থাৎ ল্যাটিন নাম Rauvolfia serpentina। সর্বপ্রথম লিওনার্ড রল্ফ ১৫৮২ সালে ইউরোপীয়দের সর্পগন্ধা উদ্ভিদ সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। তার নাম অনুসারে এটিকে রাউলফিয়া বলা হয়। এটি Apocynaceae পরিবারের একটি উদ্ভিদ এবং এর ইংরেজি নাম হল Serpentine Root, Java Devil Pepper।

সর্পগন্ধা ঐতিহ্যগত চিকিৎসায় একটি প্রধান ওষুধ। সর্পগন্ধার ঔষধি ব্যবহার ৩০০০ বছরের পুরনো। সর্পগন্ধা তেতো, তিক্ত এবং পেটের জন্য শুষ্ক ও গরম। সর্পগন্ধা হল একটি ছোট চকচকে, চিরসবুজ, বহু বছরের পুরনো ঝোপ যার শিকড় মাটির গভীরে যায়। এই গাছের বাকলের রং হলুদ। শিকড় আঁকাবাঁকা থাকে এবং প্রায় ১৮-২০ ইঞ্চি লম্বা হয়। এর মূলের ছাল বাদামী-হলুদ বর্ণের, গন্ধহীন এবং বেশ তিক্ত হয়।

এর পাতা গুচ্ছযুক্ত, ৩-৭ ইঞ্চি লম্বা, ল্যান্স আকৃতির এবং ডাঁটাযুক্ত। পাতাগুলি উপরে গাঢ় সবুজ এবং নীচে হালকা সবুজ রঙের হয়। সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ফুল ফোটে। ফল ছোট, মাংসল এবং এর সবুজ ফল পাকলে বেগুনি-কালো রঙের হয়ে যায়।

সর্পগন্ধার দরকারী অংশ হচ্ছে ফল, মূল। সর্পগন্ধার মূল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। সর্পগন্ধার প্রধান প্রজাতি ছাড়াও আরও দুটি প্রজাতি রয়েছে যা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এর মধ্যে একটি বন্য সর্পগন্ধা (Rauvolfia tetraphylla L.)। এটি একটি ছোট গুল্ম উদ্ভিদ। এর পাতা একসাথে চারটি সংখ্যায় সংযুক্ত থাকে। ফুল গুচ্ছ আকারে দেখা যায় এবং সবুজ-সাদা রঙের হয়। ফল গোলাকার, কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে বেগুনি-গোলাপী বর্ণের হয়। এর মূল লম্বা এবং ধূসর-সাদা রঙের।

সর্পগন্ধা কোথায় পাওয়া যায় বা জন্মায়?
সারা বিশ্বে সর্পগন্ধার অনেক প্রজাতি পাওয়া যায়। এটি সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে চাষ করা হয়। সর্পগন্ধা উদ্ভিদ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সর্বত্র প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। এটি প্রায় ১২০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত চাষ করা হয়।

সর্পগন্ধা কতটুকু সেবন করবেন?
গুঁড়া ৩-৫ গ্রাম এবং ক্বাথ – ১০-৩০ মিলি

সর্পগন্ধার উপকারিতা ও ব্যবহার

সর্পগন্ধা ক্ষত সারায় এবং পেটের কৃমি নাশ করে। এটি ইঁদুর, সাপ, টিকটিকি ইত্যাদি প্রাণীর অনেক ধরনের বিষ দূর করে। এটি বাত দ্বারা সৃষ্ট রোগ, ব্যথা, জ্বর ইত্যাদি নিরাময় করে। এর মূল অত্যন্ত তিক্ত, মৃদু রেচক অর্থাৎ মল নিঃসরণকারী এবং তাপ উৎপন্নকারী।

রোগ অনুযায়ী এর উপকারিতা ও ব্যবহারের পদ্ধতি (সর্পগন্ধার ঔষধি ব্যবহার) নিচে দেওয়া হল।

হুপিং কাশির চিকিৎসায়ঃ হুপিং কাশি শিশুদের একটি সংক্রামক রোগ। এটি বেশিরভাগই ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ঘটে। হুপিং কাশির ক্ষেত্রে, শক্তিশালী এবং অবিরাম কাশি দেখা যায়। ক্রমাগত কাশির কারণে রোগী ঘাবড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সে বমি করে। সর্পগন্ধা ব্যবহারে এটি নিরাময় করা যায়। হুপিং কাশিতে ২৫০-৫০০ মিলিগ্রাম সর্পগন্ধা গুঁড়ো মধুর সাথে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

শ্বাসকষ্টে ব্রঙ্কাইটিস নিরাময়েঃ দৌড়ানোর কারণে শ্বাসকষ্ট হওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়, তবে হাঁটার পরও যদি শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তবে তা একটি রোগ। শ্বাসকষ্ট হলে এক গ্রাম সর্পগন্ধা গুঁড়ো মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

আরো পড়ুনঃ সুস্বাস্থ্যের জন্য মধু খাওয়ার নিয়ম ও সময়

কলেরায় ব্যবহারঃ আলগা মল এবং বমি অর্থাৎ কলেরার ক্ষেত্রে সর্পগন্ধা মূলের গুঁড়ো ৩-৫ গ্রাম হালকা গরম পানিতে সেবন করুন। এ কারণে কলেরায় নিশ্চিত উপকার পাওয়া যায়।

রক্ত ​​আমাশয় বন্ধ করতেঃ কুটজা মূলের ১০-৩০ মিলি ক্বাথের মধ্যে ৫০০ মিলিগ্রাম সর্পগন্ধা পাউডার মেশান। এটি পান করলে রক্তাক্ত আমাশয় অর্থাৎ আলগা মল সহ রক্তাক্ত ডায়রিয়ায় উপকার হয়।

পেটের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতেঃ সর্পগন্ধা বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এই জন্য পেটের ব্যাথায় সর্পগন্ধার মূলের ক্বাথ তৈরি করে ১০-৩০ মিলি সেবন করতে হয়।

নরমাল ডেলিভারির জন্য সর্পগন্ধার উপকারিতা: আজকাল প্রসবের ক্ষেত্রে সামান্য অসুবিধা হলে সিজারিয়ান অর্থাৎ অপারেশনের মাধ্যমে ডেলিভারি করানো হচ্ছে। এটি ডাক্তারদের জন্য ভাল আয় এর উৎস হয়ে ওঠে তবে এটি আজীবন নারীদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এমতাবস্থায় সর্পগন্ধা ঔষধ ব্যবহার করলে সহজেই নরমাল ডেলিভারি করা যায়।

  • প্রসবের সময় ব্যথা হলে এবং প্রসব না হলে সর্পগন্ধার মূলের ক্বাথ সেবন করতে হবে। এটি খেলে জরায়ুতে সংকোচন শুরু হয়, যা প্রসব সহজ করে তোলে।
  • সর্পগন্ধা মূলের ২-৩ গ্রাম পাউডারে সমান অংশ চিনি মিশিয়ে নিন। এটি মধুর সাথে সেবন করলে স্বাভাবিক প্রসবে সাহায্য করে।

মাসিকের সমস্যায়ঃ সর্পগন্ধার শুকনো ফলের গুঁড়া কালো মরিচ ও আদা সহ পিষে নিন। এটি খেলে ঋতুস্রাব নিয়মিত হয়। এটি মাসিকের ব্যাধি যেমন মাসিকের সময় ব্যথা, কম বা বেশি স্রাব ইত্যাদি নিরাময় করে।

আরো পড়ুনঃ পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর উপায় ঘরোয়া পদ্ধতি, পিরিয়ডের সময় কি কি খাবার খাওয়া উচিত

গর্ভপাত পরবর্তী সমস্যায়ঃ গর্ভাবস্থার প্রথম ৩-৪ মাসে ভ্রূণের মাংস সম্পূর্ণরূপে গঠিত হয় না। এ পর্যায়ে কোনো কারণে গর্ভপাত হলে শুধু রক্ত ​​পড়ে। একে গর্ভপাত বলা হয়। গর্ভপাতের পর ব্যথা ও রক্তপাত বন্ধ না হলে সর্পগন্ধা মূলের গুঁড়া ২-৪ গ্রাম মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে উপকার হয়।

ম্যানিয়া ও মৃগী রোগেঃ ম্যানিয়া এবং মৃগীরোগ দুটোই মস্তিষ্ক সম্পর্কিত রোগ। সর্পগন্ধা মূলের গুঁড়া ১-২ গ্রাম গোলাপ জলের সঙ্গে খেলে ম্যানিয়া বা মৃগী রোগে উপকার পাওয়া যায়।

রক্তচাপ কমাতেঃ রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণে মস্তিষ্ক সঠিক পরিমাণে অক্সিজেন পাওয়া বন্ধ করে দেয়, যার কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উচ্চ রক্তচাপ হার্টে সমস্যা সৃষ্টি করে।

সর্পগন্ধা উভয় নিরাময়ে উপকারী। সর্পগন্ধা আমাদের হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। এর শিকড়ের নির্যাস উচ্চ রক্তচাপের জন্য ভালো ওষুধ। এটি ধমনী শক্ত হওয়া প্রতিরোধ করে (সর্পগন্ধার ঔষধি ব্যবহার)।

সর্পগন্ধা থেকে তৈরি ক্বাথ খেলে উচ্চ রক্তচাপ নিরাময় হয়।

অনিদ্রায়ঃ সুস্বাস্থ্যের জন্য ভালো ঘুম জরুরি। ভালো ঘুম না হলে সর্পগন্ধা আপনার জন্য খুবই উপকারী হতে পারে। এটি টেনশন উপশম এবং পেশী শিথিল করতে সাহায্য করে। এর ফলে ভালো ঘুম হয়।

ভালো ঘুমের জন্য সর্পগন্ধা মূলের গুঁড়ো ১-৩ গ্রাম পানির সাথে সেবন করুন। দুই গ্রাম খুরাসানি ক্যারাম বীজের গুঁড়া ও সমপরিমাণ চিনি দুই গ্রাম সর্পগন্ধা মূলের গুঁড়ায় মিশিয়ে নিন। রাতে ঘুমানোর আগে সাধারণ পানির সাথে খেলে ভালো ঘুম হয়।

টক্সিন দূর করতেঃ সর্পগন্ধায় ভাত নিরাময়কারী, উষ্ণায়ন এবং বিষাক্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এটি ত্বক থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে।

গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগের চিকিৎসায়ঃ সর্পগন্ধার গরম গুণের কারণে এটি পরিপাকতন্ত্রকে সুস্থ রাখে, যা পরিপাকতন্ত্রকে শক্তিশালী রাখে এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগের উপসর্গ থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে।

সাপ এবং পোকামাকড়ের কামড়ের জন্যঃ বিভিন্ন ধরনের সাপ এবং পোকামাকড়ের বিষ দূর করত সর্পগন্ধা ব্যবহার করা হয়।

  • সর্পগন্ধার মূলের গুঁড়ো ১০-২০ গ্রাম পানিতে মিশিয়ে সাপে কামড়ানোর জায়গায় লাগাতে হবে।
  • সর্পগন্ধার তাজা পাতা চূর্ণ করে পায়ের তলায় লাগালে সাপের কামড়েও আরাম পাওয়া যায়।
  • সর্পগন্ধা, চোরক, সপ্তলা, পুনর্নব ইত্যাদি একক বা মিশ্র পদার্থ ব্যবহারে বিভিন্ন প্রকার বিষের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দূর হয়।

সর্বাধিক উপকারের জন্য, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সর্পগন্ধা ব্যবহার করুন।

সর্পগন্ধার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

অতিরিক্ত সর্পগন্ধা ব্যবহারের কারণে এই অসুবিধাগুলি দেখা দিতে পারে:-

  • নার্ভাসনেস, হার্টে ভারী হওয়া, নিম্ন রক্তচাপ ইত্যাদি সমস্যা হয়।
  • কখনও কখনও এটি পেটে জ্বালাপোড়া বা হাইপার অ্যাসিডিটির সমস্যাও তৈরি করে।

তাই এটি সঠিক পরিমাণে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া উচিৎ।

কাদের সর্পগন্ধা ব্যবহার করা উচিত নয়?

  • স্তন্যদানকারী মা এবং গর্ভবতী মহিলাদের এটি খাওয়া উচিত নয়।
  • শিশুদের এটি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • এমনকি একজন মদ্যপ ব্যক্তির এটি গ্রহণ করা উচিৎ নয়।

আরো পড়ুনঃ

5/5 - (9 votes)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button