ব্রেন স্ট্রোকের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

ব্রেন স্ট্রোক (Brain Stroke) বা মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি জটিল এবং জীবনঘাতী রোগ। এটি হঠাৎ করেই হতে পারে এবং যদি দ্রুত চিকিৎসা না নেওয়া হয়, তবে তা পঙ্গুত্ব বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই লেখায় আমরা আলোচনা করব ব্রেন স্ট্রোকের কারণ, লক্ষণ, ও সময়মতো চিকিৎসা কেমন হওয়া উচিত।
ব্রেন স্ট্রোক কী?
ব্রেন স্ট্রোক তখন ঘটে যখন মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় বা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঐ অংশে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছায় না এবং মস্তিষ্কের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। এটি দুই ধরনের হয়ে থাকে:
- ইসকেমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke): অধিকাংশ ক্ষেত্রে (প্রায় ৮৫%) এই ধরনের স্ট্রোক হয়ে থাকে, যেখানে রক্তনালীর মধ্যে জমাট বাঁধা রক্ত বা প্লাক রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দেয়।
- হেমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke): মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ফেটে গিয়ে রক্তপাত হলে এই ধরনের স্ট্রোক ঘটে।
ব্রেন স্ট্রোকের কারণ
ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। নিচে কিছু প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো:
১. উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure)
উচ্চ রক্তচাপ ব্রেন স্ট্রোকের প্রধান কারণ। এটি রক্তনালীর প্রাচীর দুর্বল করে ফেলে এবং সহজেই রক্তপাত ঘটাতে পারে।
২. ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৩. উচ্চ কোলেস্টেরল
রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমে গিয়ে রক্তনালী ব্লক করে দিতে পারে, যার ফলে ইসকেমিক স্ট্রোক হয়।
৪. ধূমপান ও মাদক সেবন
এই অভ্যাসগুলো রক্তনালীর গঠন নষ্ট করে এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।
৫. স্থূলতা ও অনিয়মিত জীবনধারা
বেশি ওজন, কম এক্সারসাইজ এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণ
ব্রেন স্ট্রোকের কিছু সাধারণ ও তাৎক্ষণিক লক্ষণ রয়েছে। এই লক্ষণগুলো জানলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়:
১. হঠাৎ করে শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়া
হাত, পা বা মুখের এক পাশে দুর্বলতা বা অবশতা দেখা দিলে সতর্ক হতে হবে।
২. কথা বলতে অসুবিধা
বলার সময় জড়তা, অস্পষ্ট উচ্চারণ বা একেবারে কথা না বলতে পারা।
৩. হঠাৎ দৃষ্টি সমস্যা
এক বা দুই চোখে ঝাপসা দেখা বা অন্ধকার হয়ে আসা।
৪. ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
হঠাৎ করে হেঁটে চলতে সমস্যা হওয়া, মাথা ঘোরা বা পড়ে যাওয়া।
৫. তীব্র মাথাব্যথা
হঠাৎ শুরু হওয়া অস্বাভাবিক মাথাব্যথা হতে পারে স্ট্রোকের লক্ষণ।
মনে রাখবেন: উপরের যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
ব্রেন স্ট্রোকের তাৎক্ষণিক করণীয়
স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “Time is Brain” — অর্থাৎ, যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে, তত মস্তিষ্কের ক্ষতি কম হবে। করণীয়:
- রোগীকে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান।
- নিউরো চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা আছে এমন হাসপাতালে নেওয়া সবচেয়ে ভালো।
- প্রাথমিকভাবে CT Scan বা MRI করে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন এটি কোন ধরনের স্ট্রোক।
ব্রেন স্ট্রোকের চিকিৎসা
স্ট্রোকের চিকিৎসা নির্ভর করে এটি কোন ধরনের স্ট্রোক, রোগীর বয়স, স্বাস্থ্য অবস্থা ও কত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে তার ওপর। সাধারণভাবে নিচের চিকিৎসাগুলো করা হয়ে থাকে:
ইসকেমিক স্ট্রোকের চিকিৎসা:
- Clot-busting ওষুধ (Thrombolytics) দেওয়া হয় যদি স্ট্রোকের ৩-৪.৫ ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া যায়।
- অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট ওষুধ দেওয়া হয় রক্তের ঘনত্ব কমাতে।
- রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
হেমোরেজিক স্ট্রোকের চিকিৎসা:
- রক্তপাত বন্ধ করার জন্য ওষুধ দেওয়া হয়।
- রক্তচাপ কমানো হয়।
- বড় হেমোরেজ হলে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
পুনর্বাসন (Rehabilitation)
স্ট্রোক হওয়ার পর রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে একটি দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া দরকার হয়, যার মধ্যে থাকে:
- ফিজিওথেরাপি: অবশ অঙ্গ সচল করতে সহায়তা করে।
- স্পিচ থেরাপি: কথা বলার সমস্যার জন্য থেরাপি।
- অকুপেশনাল থেরাপি: দৈনন্দিন কাজকর্মে পুনরায় অভ্যস্ত করতে সাহায্য করে।
কখন নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ দেখাবেন?
যদি আপনাদের পরিবারের কেউ হঠাৎ করে মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা, চলাফেরায় সমস্যা, দুর্বলতা বা অবশতা অনুভব করেন, তাহলে নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কারণ সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা প্ল্যান তৈরিতে এই বিশেষজ্ঞদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ব্রেন স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়
১. উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়মিত নিয়ন্ত্রণে রাখা
২. সুষম খাদ্য গ্রহণ করা
৩. ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করা
৪. দৈনিক হাঁটা বা এক্সারসাইজ করা
৫. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
৬. মানসিক চাপ কমানো
উপসংহার
ব্রেন স্ট্রোক একটি ভয়াবহ এবং জীবনহানিকর সমস্যা হলেও সময়মতো সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতা দিয়ে অনেকাংশে প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের সুস্থ রাখতে হলে ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণগুলো চিহ্নিত করুন এবং প্রয়োজনে অভিজ্ঞ নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নিন।