রসুন এর উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম, কাঁচা ও ভাঁজা রসুন
রসুন এর উপকারিতা সম্পর্কে কম বেশি আমরা সবাই জানি। রসুনের কথা যখন মনে আসে আসে তখন প্রথম যে কথাটি সবার মনে পরে সেটা হল রসুন আমাদের হার্ট এর জন্য অনেক ভালো। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতির মুল উপাদান হিসেবে রয়েছে রসুন।
আজকে আলোচনা করবো রসুনের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে। এটি আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যের একটি প্রয়োজনীয় অংশ এবং জেনে নেবো রসুন শুধু আমাদের হৃদরোগের জন্য নয় বরং আরো অন্যান্য নানা রোগ নিরাময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রসুন দুইরকম হয়। কিছু হয় এককোয়া বিশিষ্ট এবং কিছু হয় বহুকোয়া বিশিষ্ট। এককোয়া বিশিষ্ট রসুনের দাম তুলনামূলক একটু বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের বেশিরভাগ জায়গায় বহু কোয়া বিশিষ্ট রসুনই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর গন্ধটা একটু ঝাঝালো।
প্রথমেই জেনে নেয়া যাক রসুনের স্বাস্থ্যের জন্য কি কি কি উপকারিতা রয়েছে।
Contents
স্বাস্থ্য রক্ষায় রসুন এর উপকারিতা
১. রসুন হৃদরোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়ঃ রসুনে রয়েছে সালফার, মনোসালফার এবং বায়োএকটিভ মিশ্রণ যা হৃদরোগকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এছাড়া রসুন খেলে রক্ত জমাট বাধে না তাই হার্ট অ্যাটাক এর ঝুঁকি অনেক কমে যায়। তাই প্রতিদিন সকালে দুই কোয়া করে রসুন খাওয়া উচিৎ।
২. কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণ করেঃ প্রতিদিন দুই কোয়া করে রসুন লিভারে LDL লাইপোপ্রোটিন কমিয়ে HDL লাইপোপ্রোটিন বাড়াতে সহায়তা করে। এবং লিভারে কোলেস্টেরল সংশ্লেষ কমাতে সহায়তা করে।
৩. ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করেঃ সুগারের ফলে রক্তে গুকোজ এর পরিমাণ বেড়ে যায়। ইনসুলিনের অসম ক্ষরণের ফলে ডায়াবেটিস রোগ হয়ে থাকে। রসুনে রয়েছে অ্যালিসিন নামক একটি পদার্থ যা ইনসুলিনের ক্ষরণ বাড়িয়ে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে। এর জন্য প্রতিদিন সকালে ২-৩ কোয়া রসুন খেতে হবে চিবিয়ে অথবা কুচি করে কেটে সরাসরি গিলেও খেতে পারেন।
আরো পড়ুনঃ ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা ডায়েট চার্ট ও প্ল্যান, ডায়াবেটিস কমানোর উপায় ও প্রতিকার
৪. ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণ করেঃ চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে হাইপারটেনশনের জন্য রসুনকে একটি উপযুক্ত ঔষধ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। যাদের ব্লাড প্রেশার অনেক বেশি তারা অন্যান্য ঔষুধের সাথেও রসুন খেতে পারেন। এর জন্য প্রতিদিন দুই থেকে তিন কোয়া করে রসুন খালিপেটে খেতে হবে।
৫. প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিকঃ প্রতিদিন এক থেকে দুই কোয়া রসুন আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি করবে।
৬. যৌনশক্তি ও যৌন অক্ষমতার জন্য উপকারীঃ রসুন পুরুষের শরীরে টেস্টাস্টেরন হরমোন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে এবং হেলদি শুক্রাণু তৈরিতে সহায়তা করে। প্রতিদিন দুই কোয়া রসুন এর জন্য অনেক উপকারী।
৭. আমবাত নিয়ন্ত্রণ করেঃ আমবাত এর ফলে পায়ের গীটে ব্যাথা এবং কখনো কখনো সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আঙুল এ আরষ্ট ভাব হয়। এই আমবাত নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য ওষুধের সাথে রসুন খাওয়া অনেক ভালো। দুই থেকে চার কোয়া রসুন কুচি করে কেটে প্লেটে রেখে দিন। ১০-১৫ মিনিট পর খালিপেটে এই এই রসুন খান।
কারো যদি খালিপেটে খেতে সমস্যা হয় তারা চাইলে খাওয়ার ৩০ মিনিট পর ও খেতে পারেন রসুন। এবং ব্যাথার জায়গায় চাইলে রসুন এর তেল লাগাতে পারেন।
৮. হজম শক্তি বাড়ায়ঃ সকালে খালি পেটে এক কোয়া রসুন চিবিয়ে খেয়ে ফেলে তা হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এছাড়াও রসুন শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সহায়তা করে।
৯. ওজন নিয়ন্ত্রণ করেঃ সকালে খালি পেটে লেবুর সাথে রসুন সেবন ওজন দ্বিগুণ দ্রুতগতিতে কমায়।
আরো পড়ুনঃ ওজন কমাতে আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার নিয়ম, স্বাভাবিক নিয়মে ওজন কমানোর উপায়
১০. ক্যান্সার প্রতিরোধ করেঃ নিয়মিত রসুন খেলে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা অনেক কমে যায় কারণ রসুন ক্যান্সার কোষ বিভাজন কে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। রসুনে অধিক মাত্রায় এন্টি অক্সিডেন্ট থাকায় তা ক্ষতিকর ফ্রিরেডিকেল নিয়ন্ত্রণ করে।
১১. যক্ষা নিরাময় করেঃ অন্যান্য ঔষধের পাশাপাশি রসুনের ১৫-২০ ফোটা রস অল্প পানির সাথে মিশিয়ে দিনে দুই থেকে তিনবার খেতে হবে।
১২. সর্দি কাশি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় এবং শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে বুস্ট করে। বিশেষ করে রসুন যেহেতু একটু গরম প্রকৃতির হয়ে থাকে তাই শীতকালে রসুন খেলে সর্দি কাশি হবার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
১৩.দাতের যন্ত্রণা কমিয়ে দেয়ঃ হঠাৎ ব্যথা আরম্ভ হলে অথবা মাড়ি ফুলে গেলে এক কোয়া রসুন চিবিয়ে দাঁতের যে কোনায় ব্যথা সে কোনায় রেখে দিন। ৩০ মিনিট পর থেকে ব্যাথা কমাতে সাহায্য করবে। এছাড়া রসুন পাইরিয়া রোগ সারাতেও সাহায্য করে।
১৪. রসুনে রয়েছে পটাশিয়াম, ফসফরাস এর মত উপাদান যা আমাদের হাড়কে মজবুত করতে সহায়তা করে।
১৫. হাত পা কোথাও কাঠ বা কাচ দিয়ে কেটে গেলে সেই জায়গায় রসুন ব্লেন্ড করে লাগিয়ে বেন্ডেজ করে রাখলে সহজেই ক্ষত শুকিয়ে যায়।
তাছাড়া রুপচর্চায় রয়েছে রসুনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নিচের পোস্টগুলো পড়ুন
রসুনের উপকারিতা জানার পর এবার চলুন জেনে নিই রসুন খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে,
রসুন খাওয়ার নিয়ম
রসুনে রয়েছে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল, এন্টি-ভাইরাল এন্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এলেমেন্টস। এছাড়া এতে রয়েছে আয়রন, ভিটামিন বি, সেলেনিয়াম এবং এরকম নানা পৌষক তত্ত্ব।
এতে আরো রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, কপার, ফসফরাস, আয়রন এবং ভিটামিন বি-১।
রসুন সাধারণত সকালে খালি পেটে খাওয়া উচিত। কিন্তু তা অনেকটাই নির্ভর করে আপনি কোন কারণে আর কোন সময়ে রসুন সেবন করছেন। রসুন খেতে হলে প্রথমেই তা কেটে ১৪ মিনিটের মতো খোলা জায়গায় রেখে দিন। তখন রসুনে বিদ্যমান সালফোনিক এসিড দ্রুত ভেঙ্গে অ্যালিসিনে পরিনত হয়।
প্রতি ৬ মিনিট ৩০সেকেন্ড অন্তর অন্তর ৩০ সেকেন্ড ধরে এর গুণগত মান বাড়তে থাকে। তাই প্রতি ৭ মিনিটে একবার এবং প্রত্যেক ১৪ মিনিটে দুবার এর গুণগত মানের পরিবর্তন হয়। ১৪ মিনিট পর গুণগত মান বৃদ্ধি পাওয়ায় রসুন কেটে ১৪ মিনিট খোলা জায়গায় রেখে এরপর কাচা খাওয়া কিংবা রান্নার কাজে ব্যবহার করতে বলা হয়।
যারা কাচা রসুন খেতে পারেন না, তারা চাইলে ২০০ গ্রাম রসুন কুচি করে কেটে সাথে ১০০ গ্রাম মধু মিশিয়ে একটি কাচের পাত্রে সংরক্ষণ করে প্রতিদিন সকালে তা অল্প অল্প করে চিবিয়ে খেতে পারেন।
কিন্তু খুব দরকার না হলে প্রতিদিন দুই থেকে তিন কোয়ার বেশি রসুন খাওয়া ঠিক নয়। শীত অথবা গ্রীষ্ম যেকোনো ঋতুতেই রসুন সেবন করতে পারবেন।
আরো পড়ুনঃ রাতে মধু খাওয়ার উপকারিতা ও নিয়ম, সুস্বাস্থ্যের জন্য মধু খাওয়ার নিয়ম ও সময়
ভাজা রসুন এর উপকারিতা
অনেকে অধিকতর গন্ধের কারণে রসুন খেতে পারেন না। অনেকে মনে করেন রসুন খেলে মুখ এবং শরীর থেকে তার ঝাঝালো গন্ধ আসে। তাই তাদের জন্য কাচা রসুন এর পরিবর্তে ভেজে রসুন সেবন একটি অপসন হতে পারে।কিন্তু কারো পেটের সমস্যা থাকলে ভাজা রসুন খাবার আগে একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ভাজা রসুন খেলে অন্যান্য খাবারের মতই খাওয়ার পরপরই রসুন হজম প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। এসময় রসুনের বিদ্যমান উপাদানসমূহ শরীরে মিশতে শুরু করে। দুই থেকে চার ঘণ্টা পর রসুনে বিদ্যমান anti-cancer এজেন্ট এর কাজ শুরু করে দেয়। এবং এর সাথে রসুনে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও কাজ করতে থাকে।
চার থেকে ছয় ঘন্টা পর শরীরে থাকা টি সেল, যেটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় সেই টি সেলের কাজকে ত্বরান্বিত করে। এবং আমাদের শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত মেদকে ঝড়াতে শুরু করে। ছয় থেকে দশ ঘন্টার মধ্যে রসুনে উপস্থিত অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট একটিভ হয় এবং কোনো ব্যক্তির ইনফেকশন বা কোনো ক্ষত থাকলে তা দূর করে। এবং অতিরিক্ত কোনো পুষ্টিগুন থেকে থাকলে তা শরীরে জমে পুষ্টির চাহিদা মেটায়।
রাতে ভাজা রসুন খেলে ১৫-২০ মিনিট এর মধ্যে তা হজম হয়ে শরীরে নানা উপকারে লেগে যায়। শরীরে কোলেস্টেরল কমে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
ঠান্ডায় রসুনের উপকারিতা
বুকে কফ জমে থাকলে বা কারো যদি নিয়মিত ঠান্ডার সমস্যা থাকে এবং সাথে শ্বাসকষ্ট হয়, তাদের জন্য রসুন অনেক ভালো কাজ করে।কিন্তু এই উপকারের জন্য কাচা রসুন না খেয়ে রসুন কে কুচি করে কেটে একটু ঘিতে ভেজে নিয়ে খেতে হবে দিনে দুবার।এবং প্রতিদিন দুই কোয়া রসুন এভাবে খেতে পারলে ঠান্ডার সমস্যা ধীরে ধীরে কেটে যাবে এবং ভবিষ্যতেও সহজেই আর ঠান্ডা লাগবে না।
ছোট রসুন হলে ২-৩ কোয়া এবং বড় রসুন হলে ২ কোয়াই যথেষ্ট।
চুলের জন্য রসুনের উপকারিতা
চুল পড়ার সমস্যা রোধ করে চুলের গোড়া মজবুত করতে রসুনের তেল অনন্য ভূমিকা পালন করে। রসুনে রয়েছে মিনারেলস, ফসফরাস, সালফার যা আমাদের চুলের ফলিকলকে মজবুত করে। এছাড়াও যদি আপনাদের স্কাল্পের কোন নির্দিষ্ট স্থানের চুল পড়া অনেক বেশি বৃদ্ধি পায় তাহলে রসুনের কাচা অংশ নিয়ে সেই জায়গায় ঘসতে থাকুন। রসুনে থাকা জিংক এবং সালফার আক্রান্ত স্থানে চুল গজাতে সাহায্য করবে।
রসুনের তেল বানানোর জন্য প্রথমেই কিছু রসুন কুচি করে কেটে নিতে পারেন। এখন আপনার পছন্দমতো যেকোনো তেল নিয়ে তা একটি পরিষ্কার পাত্রে নিয়ে চুলায় কিছুক্ষণ উত্তপ্ত করতে বসিয়ে দিন এবং এতে কুচি কাটা রসুন বা আস্ত রসুন ও চাইলে দিয়ে দিতে পারেন। ৫ মিনিট পর্যন্ত তা গরম করে নিন। এবং তা একটি বায়ুরোধী কাচের পাত্রে সংরক্ষণ করুন।
সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন এই তেল ব্যবহার করতে পারবেন। এবং ১৫ দিন পর্যন্ত এই তেল সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন।এবং জেনে রাখা ভালো এই তেলের কোনো সাইড ইফেক্ট নেই এবং চুলের প্রতিটি সমস্যার সমাধানেই এটি কার্যকর ভুমিকা পালন করে। নিচের পোস্টগুলো আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ
- চুল পড়া বন্ধ ও ঘন করার উপায়
- চুল পড়া বন্ধ করার উপায়
- চুল ঘন করার উপায় naturally
- খুশকি দূর করার উপায় প্রাকৃতিকভাবে
- চুল সিল্কি করার উপায়
- চুল স্ট্রেইট করার নিয়ম
- চুল বাঁধার সহজ নিয়ম
কাঁচা রসুনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা অপকারিতা
রসুনের যেমন উপকারিতা আছে তেমনি নিয়ম না মেনে রসুন খাওয়ার কিছু ক্ষতিকর দিক বা অপকারিতাও রয়েছে।
কারো লিভারজনিত সমস্যা থাকলে কাঁচা রসুন খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
লো ব্লাড প্রেসার থাকলেও কাঁচা রসুন খাওয়া উচিত নয়।
অনেকের কাচা রসুন খেলে নিঃশ্বাস এ দুর্গন্ধ হয়, তারাও কাচা রসুন না খেয়ে ভাজা রসুন খেতে পারেন।
এছাড়াও কেউ যদি রক্তকে পাতলা করার জন্য ওষুধ সেবন করে থাকে তার সাথে রসুন খাওয়া উচিত নয়।
গর্ভাবস্থায় রসুন সেবন করা উচিত নয় এবং যে মায়েরা বেস্ট ফিডিং করাচ্ছেন তারাও রসুন খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন না হয় বাচ্চার পেটে ব্যথা হতে পারে। এছাড়া কোন সার্জারি অপারেশন এর আগে রসুন সেবন করা উচিত নয়।
কাচা রসুন খেলে যদি কারো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না। এই আর্টিকেলে ব্যবহৃত এক বা একাধিক কপিরাইটবিহীন ছবি Freepik.com থেকে সংগৃহীত হয়েছে।