গল্প

কোয়ারেন্টাইনে একদিন

বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। একদম সকাল থেকেই। ব্যালকনিতে এসে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম মানুষের আনাগোনা কম। একজন রিক্সায় করে আরেকজন ছাতা হাতে হেঁটে যাচ্ছে। গুটিকয়েক মানুষ বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় পাশের একটা দোকানে আশ্রয় নিয়েছে। হঠাত এক পশলা বৃষ্টি এসে আমার গেঞ্জিটা ভিজিয়ে দিল।

আমার গায়ের কালো রঙের গেঞ্জিটা এবছর মাহিয়া আমাকে আমার জন্মদিনে উপহার দিয়েছে। মাহিয়ার সাথে অনেক দিন দেখা নেই। দেশে এখন মহামারি চলছে। শুধু দেশে নয়, পুরো বিশ্বেই মহামারি। আমাদের ছোট মফস্বল শহরটা এখন রেড জোনে আছে। এক বাসা থেকে আরেক বাসায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। তার উপর মাহিয়ার বাবা করোনা পজিটিভ। আমি তাদের বাড়ি যেতে চাইলেও পারিনা। বাবা মা পেছন থেকে টেনে ধরে। বলে, ঐ বাড়িতে করোনা আছে। যাইস না।

সকালে মাহিয়া আমাকে একটা শাড়ি পড়া ছবি পাঠিয়েছে। বিছানায় বসা। হাতে চুড়ি আর কপালে টিপ পড়েছে। সেজেছে সে আমার জন্য। কিন্তু এই সাজ তার চোখের নিচের কালিটা দূর করতে পারেনি। দেখে খুব মায়া হলো আমার। কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। স্ট্রং মেয়ে হওয়া সত্বেও সে ভেঙ্গে পড়েছে।

আমিও একবার এরকম ভেঙ্গে পড়েছিলাম। সেমিস্টার ফাইনালে খারাপ হওয়ায় হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই মুহূর্তে মাহিয়া আমাকে সাহস জুগিয়েছে। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তখনও তার সাথে আমার প্রেম হয়নি। কিন্তু সে আমাকে পছন্দ করতো। আমিও করতাম।  সে ক্লাসের সেরা ছাত্রীদের মধ্যে একজন।

হেল্প না চাইলেও সে আমাকে হেল করতো। পড়াশোনায় উৎসাহ দিত। আমি পড়তে বসেছি কিনা খোঁজ খবর নিত। এক সময় আমি তার মায়ায় পড়ে যাই। তাকে প্রপোজ করি। সে প্রথমে রাজি হয়নি। সে বলেছিল আমি কোন রিলেশনে জড়াতে চাইনা। আমি বুঝতে পারছিলাম সে আমাকে একটু কষ্ট দেওয়ার জন্য না করে দিয়েছিল।

তাকে না পেলে আমি কিরকম কষ্ট পাই এটা দেখতে চেয়েছিল সে। এরপরদিন সে আমাকে নিজেই এসে বলল, “আমার বয়ফ্রেন্ড হবি?” আমার খুশি আর দেখে কে। সে দিনটার কথা ভাবলে এখনো রোমাঞ্চিত হই।

বাইরে এখনো বৃষ্টি। মনে মনে সংকল্প করলাম, বৃষ্টিটা থামলেই মা বাবার চোখ ফাকি দিয়ে মাহিয়াদের বাসায় যাবো। বৃষ্টি থামলো তিনটায়। বাবা মা তখন খাওয়া দাওয়া করে রুমে রেস্ট নিচ্ছিল। আমি চুপিচুপি রুম থেকে বের হয়ে পড়লাম। আমাদের বাসা থেকে মাহিয়াদের বাসায় যেতে ২০মিনিট সময় লাগে। রাস্তায় এসে দেখলাম রিক্সা, ইজিবাইক, মিনিবাস কিছুই নেই। লকডাউনে এসব গাড়ির ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া আজকে ছুটির দিন। কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ। টানা ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে অনেক কষ্টে একটা রিক্সা পেলাম। রাস্তা ফাঁকা থাকায় ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মাহিয়াদের বাসায়। তিন তলা ভবনের নিচ তলায় ভাড়া থাকে ওরা। তিনটি রুম, মাঝখানে ফাঁকা। রাস্তায় কয়েকজন লোক আড়চোখে তাকালো আমার দিকে। এ বাড়িতে করোনা রোগী আছে। তার জন্যই বোধ হয় তাদের এরকম দৃষ্টি। আমি উত্তর রুমের জানালা দিয়ে চোখ রাখলাম। মাহিয়ার বাবা শুয়ে আছে। তার মানে মাহিয়া দক্ষিন রুমে। সেখানে গিয়ে দেখলাম খাটে হেলান দিয়ে বই পড়ছে মাহিয়া। আমার উপস্থিতি টের পায়নি। আমি নিচু স্বরে ডাকলাম তাকে।

আওয়াজ শুনে সে জানালার দিকে ফিরে তাকালো। আমাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। পরক্ষনেই আবার গম্ভীর ভাব নিয়ে বললো, “কিরে, বাইরে কেন? ভেতরে আয়।”

“না, ভেতরে আসব না। এ বাড়িতে প্রবেশ তো নিষেধ।”

“তা ঠিক বলেছিস। আচ্ছা তুই দাঁড়া, আমিই বাইরে আসতেছি।”

বইটা টেবিলে রেখে মাহিয়া বাইরে বেরিয়ে আসল।

“তোর আম্মু কোথায়?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

“আম্মু কিচেনে। তা কি মনে করে আসলি”

“তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিল”

“মোবাইলে দেখে মন ভরে না বুঝি”

“না। তুই একটু মোটা হয়েছিস। কিন্তু চোখের নিচে কালি কেন?”

“চিন্তায়। তোর খবর কি বল?”

ভালোই। তোর বাবার শরীরটা কেমন এখন?”

“আগের মতই। অনেক শ্বাসকষ্ট। তাকে নিয়েই তো আমার চিন্তা বেশি।”

আমি মাহিয়াদের বাসার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে এইদিকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে ফেললাম। মাহিয়া বলল, “আচার বানিয়েছি। খাবি?”

“তাই নাকি। তুই আচার বানাইতে পারিস?”

“এই কোয়ারেন্টাইনে শিখেছি।” বলে লজ্জা পেল সে।

“আর কি শিখেছিস?”

“রান্না করা, রুমালে নকশা করা। সারাদিন মোবাইল চালিয়ে কি আর সময় কাটে?”

হাসলাম আমি। মাহিয়াও হাসলো।

সেই মুহুর্তে তিন চারটা পুলিশ দেখলাম আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে। ভয় পেয়ে গেলাম, তারা আবার কিছু বলে কিনা আমাদের। মাহিয়াকে পুলিশদের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, “ওরা কি তোদের বাড়ি পাহাড়া দেয় নাকি?”

“আর বলিস না। ওরা জ্বালাইয়া মারছে। অরাই লকডাউন দিছে। মাঝে মধ্যে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যায়।” বলে রাগ ঝারল মাহিয়া।

“এটা তো খারাপ কিছু না,” বললাম আমি।

“খারাপ হতো না যদি এদের মধ্যে এক যুবক পুলিশ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে না থাকতো। মনে হয় যেন গিলে খাবে আমায়।” আমি হাসলাম। মাহিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম এখন তার রাগান্বিত মুখ। একটু আগেই হাসছিলো আর লজ্জা পাচ্ছিলো।

লজ্জা, হাসি আর রাগ এ তিনয়ের মিশ্রন যে মায়ার সৃষ্টি করে সে মায়া থেকে কী পালিয়ে আসা সম্ভব? তবুও আমি পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে বিদায় নিতে চাইলাম।

মাহিয়া বলল, “আম্মুর সাথে দেখা করবি না?”

“আজকে না। লকডাউন শেষ হোক,” বললাম আমি।

রুমে গিয়ে আচার নিয়ে আসলো মাহিয়া। সে আচার সঙ্গে করে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। মাহিয়াকে বললাম, “নিজের খেয়াল রাখিস মাহিয়া। আমি গেলাম। রাতে কথা হবে।”

মাহিয়া হাসিমুখে বিদায় জানালো আমাকে। এ পরিস্থিতিতেও মেয়েটা কেমন হাসতে পারে।

রাস্তা আগের মতই ফাঁকা। চারদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। বুকটা কেমন হা হা করে উঠলো। হঠাত এক মাঝবয়েসী লোক আমার কাছে এসে বললো,  “ভাই মাস্ক লাগবে?”

এই লোকটাকে চিনি আমি। এই পাড়াতেই একটা টংয়ের দোকান ছিল তার। লকডাউনের কারনে দোকানটা তার বন্ধ। এখন রোজগারের জন্য হয়তো রাস্তায় রাস্তায় মাস্ক বিক্রি করে বেড়ায়। এ মহামাড়িতে মানুষের কি বেহাল অবস্থা। আশা করি শীঘ্রই এই মহামারি কেটে যাবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে একদিন।

লোকটার কাছ থেকে তিনটা মাস্ক কিনে বাসায় ফেরার আগে মনে মনে বললাম, “খোদা, লোকটি যেন শীঘ্রই আবার তার আগের পেশায় ফিরে যেতে পারে।”

5/5 - (13 votes)

Rajib Ahammed Sujon

I’m Rajib Ahammed, a writer at Shopnik who enjoys creating content at the intersection of education and entertainment. Whether it's simplifying complex topics or sharing engaging stories, I believe learning should be fun and accessible. From study tips to pop culture insights, I aim to keep readers informed and entertained every step of the way.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button