বিসিএসশিক্ষা

চর্যাপদ কি এবং চর্যাপদের বিষয়বস্তু

4.4/5 - (322 votes)

এই যে আমাদের বিশাল বৈচিত্রময় বাংলা সাহিত্য, এটা কি রাতারাতি গড়ে ওঠেছে? না, হাজার বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে আমাদের এই বাংলা সাহিত্য। যে সাহিত্য আজ আমাদের তথা বাঙ্গালি জাতির পরিচয় বহন করে। যে সাহিত্য আমাদের হাজার বছরের সংগ্রামের কথা তুলে ধরে। সেই বাংলা সাহিত্য হাজার বছরের পুরনো। বাংলা সাহিত্যের বয়স প্রায় এক হাজার বছরের একটু বেশি। তাহলে চর্যাপদ কি? এককথায় চর্যাপদ হল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিদর্শন।

বাংলা সাহিত্য বাঙ্গালি জাতির প্রাণস্রোতের প্রবাহ। সময় তার আপন গতিতে বয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে আমাদের বাঙ্গালি জাতিও পরিবর্তিত হয়েছে। বাঙ্গালি জাতির পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে আমাদের বাংলা সাহিত্য। এভাবের সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে বাংলা সাহিত্য আজ এত সমৃদ্ধ। কিন্তু, এই সাহিত্য রচনার শুরু কোথা থেকে?

বাংলা সাহিত্য রচনা মূলত শুরু হয় দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনপ্রাপ্তি, সময়ের প্রবণতা ও সাহিত্যের বৈশিষ্ট অনুসারে বাংলা সাহিত্যের সময়কালকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ

  • প্রাচীন যুগঃ ৯৫০ – ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ।
  • মধ্যযুগঃ ১৩০০ – ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ।
  • আধুনিক যুগঃ ১৮০১ – বর্তমান।

এই তিন যুগেই বাংলা সাহিত্য রচিত হয়েছে। যার শুরু হয়েছে প্রাচীন যুগ থেকে। প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নিদর্শন স্বরূপ যে গ্রন্থটি পাওয়া গেছে তার নামই “চর্যাপদ” এবং এই চর্যাপদকেই বলা হয় বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ। তারপর মধ্যযুগের নিদর্শন স্বরূপ প্রচুর কাহিনীকাব্য এবং গীতিকবিতা পাওয়া গিয়েছে। আর বর্তমানে চলছে আধুনিক যুগ।

আমার এই লেখায় আমি বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাস তুলে ধরবোনা। এই লেখায় শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন “চর্যাপদ” নিয়ে লেখবো। চেষ্টা করবো চর্যাপদ কি এবং চর্যাপদ সম্পর্কিত সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। যদিও সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয় তবুও যতটুকু দেওয়া যায় ততটুকু দেবার চেষ্টা থাকবে।

চর্যাপদ কি?

চর্যাপদ মূলত কতগুলো পদ বা কবিতা বা গানের সংকলন। তখনকার সময়ে কবিতা পড়া হতোনা। কবিতা গানের মত করে গাওয়া হতো। তাই অনেকেই একে গানের সংকলন বলে থাকেন। চর্যাপদ “সান্ধ্য” ভাষায় রচিত।

যে ভাষা নির্দিষ্ট কোন রূপ পায়নি, যে ভাষার অর্থো একাধিক অর্থাৎ আলো-আঁধারের মত, সেই ভাষাকে পন্ডিতগন সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বলেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা, সৌমিত্র শেখর।

চর্যাপদের অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে “আশ্চর্য চর্যাচয়”, “চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়”, “চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়” এবং “চর্যাগীতিকোষ”। তবে আমাদের ভাগ্যভালো এই দাঁত ভেঙে যাওয়া নাম গুলো সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়নি। তাই আমরা বাংলা সাহিত্যের সর্ব প্রাচীন গ্রন্থকে “চর্যাপদ” নামে চিনি। চর্যাপদের পদগুলো মূলত প্রাচীন কোন ছন্দে রচিত তা জানা না গেলেও চর্যাপদের ছন্দ গুলোর সাথে “মাত্রাবৃত্ত” ছন্দের অনেকটা মিল লক্ষ্য করা যায়।

আরো পড়ুনঃ প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২২ ও প্রস্তুতির গাইডলাইন

চর্যাপদ কে, কিভাবে, কোথা থেকে আবিষ্কার করেন?

১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার ৩য় দফায় নেপাল ভ্রমণকালে নেপালের রাজদরবারের “রয়েল লাইব্রেরি” থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। এখন প্রশ্ন আসে, চর্যাপদ যদি বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হয় তাহলে সেটা নেপালে গেলো কি করে?

এই প্রশ্ন নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। এই প্রশ্নের উত্তরে যে দুইটি উত্তর উপরের দিকে আসে তার মধ্যে একটি তারাপদ মুখোপাধ্যায় এর। তার মতে “এক সময়ে নেপালে বসবাসরত বাঙালিরা বাংলা লিপিতে পুথি লিখতেন এবং তাই নেপালে বাংলা অক্ষরে বাঙালি লিপিকারের পুথির অস্তিত্ব অভাবিত নয়”। অন্য উত্তরটি দিয়েছে সত্যজিৎ চৌধুরী, তার মতে, “তুর্কি আক্রমনের সময়ে পুথিপত্র নিয়ে বাংলার পন্ডিত মানুষেরা নেপালে, তিব্বতে চলে গিয়েছিলেন”। এই মতই সর্বাধিক মান্য।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের সাথে আরো পান চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদের দোহা এবং অদ্বয় বজ্রের সংস্কৃত সহজাম্নায় পঞ্জিকা, কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদের দোহা, আচার্যপাদের সংস্কৃত মেখলা নামক টীকা। এগুলোর সাথে আগের আবিষ্কৃত দুটি গ্রন্থ – ডাকার্ণব ও দোহাকোষ। এগুলো মিলিয়ে একসাথে ১৯১৬ সালে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা” নামে একটি বই প্রকাশের মাধ্যমে চর্যাপদকে জনসম্মুখে নিয়ে আসেন।

পরবর্তীতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পান্ডুলিপিটি নেপালের রাজদরবারের লাইব্রেরিতে ফেরত দেন। বিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে লাইব্রেরিটি বন্ধ হয়ে যায় এবং সেটি জাদুঘরে পরিণত হয়। লাইব্রেরির সকল বই নেলাপালের জাতীয় আর্কাইভসে নেওয়া হলেও চর্যাপদের মূল এবং সম্পূর্ণ পান্ডুলিপিটি আর পাওয়া যায়নি।

আরো পড়ুনঃ পদ্মা সেতু সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান ২০২২

চর্যাপদের পদ পরিচিতি

চর্যাপদে মোট সাড়ে ৪৬টি পদ রয়েছে। ৪৬টি পূর্ণ পদ আর একটি পদের ছেড়া অংশ পাওয়া গিয়েছে। চর্যাপদের কবির সংখ্যা ২৩, মতান্তরে ২৪। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ তার ‘বুড্‌ডিস্ট মিস্টিক সঙ্‌স’ গ্রন্থে ২৩ জন এবং সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে ২৪ জনের কথা বলেছেন।

  • চর্যাপদের প্রথম পদটি রচনা করেন লুইপা।
  • চর্যাপদে সবচেয়ে বেশি পদ রচনা করেছেন ‘কাহ্নপা’, তার রচিত পদের সংখ্যা ১৩টি। পাওয়া গিয়েছে ১২টি। [৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫]
  • দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদের রচয়িতা ‘ভুসুকুপা’, তার রচিত পদের সংখ্যা ৮টি। [৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩, ৪৯]
  • চর্যাপদের ২৪, ২৫ ও ৪৮ নং পদটি পাওয়া যায়নি।
    • ২৪ নং পদের রচয়িতা কাহ্নপা।
    • ২৫ নং পদের রচয়িতা তন্ত্রীপা।
    • ৪৮ নং পদের রচয়িতা কুক্কুরীপা।
  • ভুসুকুপা রচিত ২৩ নং পদটি খন্ডিত আকারে পাওয়া গেছে। এই পদের ৬টি পঙক্তি পাওয়া গেলেও বাকি ৪টি পাওয়া যায়নি।

**প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যার যে তিব্বতি অনুবাদ সংগ্রহ করেন তাতে আরও চারটি পদের অনুবাদসহ ওই খণ্ডপদটির অনুবাদও পাওয়া যায়। মূল পুঁথির পদের সংখ্যা ছিল ৫১। [উইকিপিডিয়া]

চর্যাপদের কবিদের নামের শেষে ‘পা’ যুক্ত কেন?

কবিতা মানে পদ। আর যারা পদ রচনা করতে তাদের বলা হতো পাদ। আমরা আজ যাদের কবি বলে চিনি। সেই পাদ থেকেই পা হয়েছে।

চর্যাপদের কবিদের সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যঃ

  • কাহ্নপা কাহ্নু, কাহ্নি, কাহ্নিল, কৃষ্ণচর্য, কৃষ্ণবজ্রপাদ নামেও চর্যাপদে পরিচিত হয়েছেন।
  • ড. সুকুমার সেনের মতে কুক্কুরীপার ভাষার সাথে মহিলাদের ভাষার মিল রয়েছে তাই অনেকে তাকে মহিলা কবি মনে করে।
  • ধর্মপার গুরু ছিলেন কাহ্নপা।
  • বিরুপা ও ভাদেপার গুরু ছিলেন জালন্ধরীপা। জালন্ধরীপা ও কঙ্কণপার গুরু ছিলেন কম্বলম্বরপা।
  • বীণাপার গুরু ছিলেন ভাদেপা।
  • অনেকের ধারণা ভুসুকুপা রাজপুত্র ছিলেন। ভুক্তি (ভু), সুপ্তি (সু), কুটিরে (কু) অবস্থান ছাড়া আর কিছু করতেন না বলে তাকে ভুসুকু নামে ডাকা হতো।
  • লুইপার গুরু ছিলেন শবরপা। শবরপার গুরু ছিলেন নাগার্জুন।
  • ডোম্বীপা ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ছিলেন। ডোম্বীপার গুরু ছিলেন বিরুপা।

চর্যাপদ সম্পর্কিত বিবিধ প্রশ্ন ও উত্তরঃ

  • চর্যা কথার অর্থ কী?
    • আচরণীয়।
  • হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আগে পুঁথি আবিষ্কারে কার দায়িত্ব ছিল?
    • রাজেন্দ্রলাল মিত্র।
  • চর্যার কোন পদকার নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিয়েছেন? কত সংখ্যক পদে?
    • ভুসুকুপা, ৪৯ নং পদে।
  • চর্যাপদে কোন কোন নদীর নাম পাওয়া যায়?
    • গঙ্গা ও যমুনা, ডোম্বীপার পদে।
  • চর্যাপদে উল্লিখিত একমাত্র ফলের নাম কি?
    • তেঁতুল।
  • চর্যাপদের কোন কবিকে চিত্র ধর্মী কবি বলা হয়?
    • ভুসুকুপা।
  • চর্যাপদের ভাষাকে কে হিন্দী বলে দাবী করেছেন?
    • বিজয়চন্দ্র মজুমদার।
  • চর্যাপদের পুঁথিটি কিসের উপর লেখা?
    • তালপাতা
  • চর্যায় কোন খেলার উল্লেখ আছে?
    • নয়বল বা দাবা।
  • চর্যাপদে মোট কতগুলো রাগ আছে?
    • ১৭ টি।
  • চর্যাপদের ভাষা যে বংলা তা কে প্রমাণ করেন?
    • ১৯২৬ সালে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়।
  • চর্যার ভাষা যে হিন্দি নয় তা কে প্রমাণকরেন?
    • সুকুমার সেন।
  • চর্যাপদে চিত্রত জনগোষ্ঠীর নামগুলো কি কি?
    • তাঁতি,ব্যাধ,শবর, মাহুত,শুঁড়ি,কাপালিক।
  • চর্যাপদের দুজন বিদেশি গবেষকের নাম করুন।
    • জি তাকি, আর্ণল্ড বেক।
  • চর্যার কোন পদকর্তা নিজেকে বাঙালি বলে দাবি করেছেন?,
    • ভুসুকুপা (পূর্ববঙ্গ)।
  • চর্যার পদে বাংলা দেশের কোন নদীর নাম আছে?
    • পদ্মা নদীর
  • পদ্মা নদীর উল্লেখ কাঁর কততম পদে আছে?
    • ভুসুকুপার ৪৯ নং পদে
  • বেশিরভাগ পদ কয়টি চরণে লিখিত?
    • ১০টি।
  • চর্যাপদকে মৈথিলী ভাষার আদি নিদর্শন কে বলেছেন?
    • জয়কান্ত মিশ্র তাঁর।
  • নবচর্যাপদের সম্পাদক কে?
    • অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায।
  • চর্যাপদে কতটি প্রবাদ বাক্য আছে?
    • ৬টি।
  • চর্যাপদে কোন কোন যান চলাচলেরউল্লেখ আছে?,
    • রথ, হাতি, নৌকা।

তথ্যসূত্রঃ

  1. লাল নীল দীপাবলি, হুমায়ুন আজাদ।
  2. বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা, ড. সৌমিত্র শেখর।
  3. ইন্টারনেট।

আমি আশা করি আপনি চর্যাপদ কি এবং চর্যাপদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে খুবই তথ্যবহুল একটি পোস্ট আছে আমাদের। বাংলা সাহিত্যে প্রস্তুতি নিতে নিচের পোষ্টটি পড়ুন।

জমির পরিমাপ সম্পর্কে আমাদের ওয়েবসাইটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্ট দেওয়া আছে এখনই দেখে নিন।

zahid

A professional SEO Expert & Digital Marketing Consultant. Enhancing online visibility of business is my job. Keeping update myself with new search algorithm update and stay top on search results is my passion.

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button