স্বাস্থ্য

তিলের তেলের উপকারিতা

তিল এবং এর তেলের সাথে সবাই পরিচিত। শীতের মৌসুমে তিলের খাজা খুব ধুমধাম করে খাওয়া হয়। রঙের পার্থক্যের কারণে তিল তিন প্রকার, সাদা, লাল ও কালো। আয়ুর্বেদে কালো তিলের বীজ থেকে প্রাপ্ত তেলকে ওষুধ হিসেবে সর্বোত্তম বলে মনে করা হয়।

তিল গাছ 30-60 সেমি উঁচু, তীব্র গন্ধযুক্ত, শাখাযুক্ত বা শাখাবিহীন, ভেষজ উদ্ভিদ। এর কাণ্ড সূক্ষ্ম বা লোমশ, উপরের অংশের শাখা এবং কাণ্ড চতুর্ভুজাকার ও খাঁজযুক্ত। এই উদ্ভিদের সর্বত্র সিক্রেটরি গ্রন্থি পাওয়া যায়। এর পাতাগুলি বড়, পাতলা, নরম, পিউবেসেন্ট, উপরের দিকের পাতাগুলি কিছুটা লম্বা এবং 6-15 সেমি লম্বা এবং 3-10 সেমি চওড়া। এর ফুল বেগুনি, গোলাপী বা সাদা বেগুনি, হলুদ চিহ্নযুক্ত। এর শুঁটি 2.5 সেমি লম্বা, 6 মিমি চওড়া, লোমহীন, সোজা, চতুর্ভুজাকার এবং 4-স্লটেড। তিলের বীজ অসংখ্য, 2.5-3 মিমি লম্বা, 1.5 মিমি চওড়া, মসৃণ বাদামী বা সাদা রঙের। এর ফুল ও ফলের সময়কাল আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।

তিল মসলাযুক্ত, মিষ্টি, প্রকৃতিতে ভারী, সুস্বাদু, অ্যালিফ্যাটিক, প্রভাবে উষ্ণ, কফ ও পিত্ত কমায়, শক্তিশালী, চুলের জন্য উপকারী, স্পর্শে শীতল, ত্বকের জন্য উপকারী, দুধ বর্ধক, ক্ষত সারাতে উপকারী, দাঁতের উন্নতি ঘটায়। প্রস্রাবের প্রবাহ কমায়।
কৃষ্ণ তিল শ্রেষ্ঠ এবং বীর্য বা অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি করে, সাদা তিল মধ্যম এবং লাল তিল নিম্নমানের।

কৃষ্ণ তিল (কালো তিল) শ্রেষ্ঠ।
সাদা তিল মাঝারি, অন্যান্য তিলের চেয়ে কম গুণসম্পন্ন।
তিলের তেল মিষ্টি, পিত্তনাশক, কার্সিনোজেনিক, সূক্ষ্ম, উষ্ণ, আলিফ্যাটিক, খাদ্যতালিকাগত এবং তিক্ত।
তিলের পেস্ট মিষ্টি, সুস্বাদু, শক্তিশালী এবং পুষ্টিকর।
তিল পিনিয়াক মিষ্টি, সুস্বাদু, তীক্ষ্ণ, রক্তপিত্ত (নাক ও কান থেকে রক্তপাত) সৃষ্টিকারী এবং চোখের রোগ সৃষ্টিকারী, শুষ্ক, তিক্ত, শক্তিশালী, বলপ্রদানকারী, কাশি কমায় এবং প্রমেহ বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

বিশেষ: আয়ুর্বেদে প্রধানত সাদা এবং কালো তিলের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তবে উদ্ভিদ বিজ্ঞান অনুসারে, সাদা এবং কালো তিল একই নাম পায়। আয়ুর্বেদ অনুসারে, উভয়ের বৈশিষ্ট্য এবং ঔষধি ব্যবহার আলাদা বলে মনে করা হয়। কালো তিল সাদার চেয়ে ঔষধি ব্যবহারের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তিলের উপকারিতা ও ব্যবহার

আসুন জেনে নিই বিভিন্ন রোগে তিলের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে-

অকালে পাকা চুলে তিলের তেলের উপকারিতা

চুলের সমস্যা আজকের দূষণ এবং ভারসাম্যহীন জীবনযাত্রার ফল। চুল পড়া, চুল অকালে পাকা হয়ে যাওয়া, টাক পড়া, খুশকির সমস্যা ইত্যাদি এমন সমস্যা যার কারণে কমবেশি মানুষ চিন্তিত। এসব রোগে তিলের তেলের ব্যবহার খুবই উপকারী বলে প্রমাণিত হয়।

তিলের মূল ও পাতার ক্বাথ তৈরি করে সেই ক্বাথ দিয়ে চুল ধুয়ে নিলে চুল সাদা হয় না।
কালো তিলের তেল বিশুদ্ধ অবস্থায় চুলে লাগালে চুল অসময়ে সাদা হয় না। প্রতিদিন মাথায় তিলের তেল মালিশ করলে চুল নরম, কালো ও ঘন থাকে।
ঘি ও মধুতে তিল ফুল ও গোক্ষুর পিষে মাথায় লাগালে চুল পড়া ও খুশকি দূর হয়।
আমলকি, কালো তিল, কমল জাফরান ও লিকার গুঁড়ো সমপরিমাণে মধু মিশিয়ে মাথায় লাগালে চুল লম্বা ও কালো হয়।

ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়ায় তিল উপকারী

ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া নামক রোগে ট্রাইজেমিনাল নার্ভে তীব্র ব্যথা হয় যা চোয়াল থেকে কান পর্যন্ত চলে। এই অবস্থাকে নিউরালজিয়া বলা হয়।

এ জন্য দুধের সঙ্গে তিল পিষে, ব্যথাযুক্ত স্থানে ঘাম দিলে বা মাথায় লাগালে সূর্যবর্ত নামক মাথাব্যথায় উপকার পাওয়া যায়।
তিল পাতা ভিনেগার বা পানিতে পিষে মাথায় লাগালে মাথাব্যথা দূর হয়।

চোখের রোগের জন্য তিলের উপকারিতা

চোখের রোগ যেমন সাধারণ চোখের ব্যথা, রাতকানা, লাল চোখ ইত্যাদি। এই সব ধরনের সমস্যায় তিল থেকে তৈরি ঘরোয়া প্রতিকার খুবই উপকারী।

শরৎকালে তিলের ফুলের ওপর পড়ে থাকা শিশির ফোঁটা তুলে মসলিন কাপড় বা অন্য কোনো উপায়ে শিশিতে রাখুন। এই শিশির কণা চোখে রাখলে উপকার পাওয়া যায়।
কালো তিলের ক্বাথ তৈরি করে চোখ ধুলে চোখের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
80টি তিল ফুল, 60টি পিপ্পলি, 50টি জুঁই ফুল এবং 16টি গোলমরিচ জলের সাথে পিষে প্রদীপের মতো করে পিষে কাজলের মতো লাগালে চোখের ছানি ইত্যাদি রোগে উপকার পাওয়া যায়।
তিলের তেল, বহেদার তেল, ভৃঙ্গরাজের রস এবং বিজয়সরের ক্বাথ মিশিয়ে লোহার কড়াইতে তেল রান্নার পর প্রতিদিন ১-২ ফোঁটা নাক থেকে সেবন করলে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পায়।

দাঁতের রোগে তিলের উপকারিতা

তিল যে শুধু শরীরে উপকার করে তাই নয়, দাঁতের জন্যও তিল উপকারী।
প্রতিদিন 25 গ্রাম তিল চিবিয়ে খেলে দাঁত মজবুত হয়।
মুখে তিল ভরে ৫-১০ মিনিট রাখলে পায়োরিয়ায় উপকার পাওয়া যায় এবং দাঁত মজবুত হয়।

তিল কাশির চিকিৎসা করে
আবহাওয়া পরিবর্তন হলে ঘন ঘন কাশি হলে এভাবে তিল খেলে আরাম পাওয়া যায়।
তিলের ক্বাথ 30-40 মিলিলিটারে ২ চামচ চিনি মিশিয়ে খেলে কাশিতে উপশম হয়।
তিল ও চিনি সিদ্ধ করে পান করলে শুকনো কাশি দূর হয়।

তিল রক্ত ​​আমাশয়ে উপকারী
মশলাদার বা প্যাকেটজাত খাবার খাওয়ার কারণে যদি সংক্রমণ হয়ে থাকে এবং মলের সঙ্গে রক্ত ​​আসছে, তাহলে তিলের ঘরোয়া প্রতিকারে উপকার পাওয়া যায়।
৫ গ্রাম তিলের গুঁড়াতে সমপরিমাণ চিনি মিশিয়ে ছাগলের দুধের সঙ্গে খেলে ডায়রিয়ায় উপশম হয়।

তিল পাইলসের চিকিৎসা করে
আপনার যদি পাইলস রোগ থাকে এবং আপনি যদি খাবারে অনিয়ম করেন তাহলে পাইলসের রোগ বাড়তে পারে। তিলের ঘরোয়া প্রতিকার তাতে খুবই উপকারী প্রমাণিত হয়।
পানির সাথে তিল পিষে মাখনের সাথে দিনে তিনবার খাওয়ার এক ঘন্টা আগে খেলে মূত্রাশয় উপশম হয় এবং রক্ত ​​পড়া বন্ধ হয়।
তিল পিষে, গরম করে পুঁটলির মতো বেঁধে রাখলে আরশে উপকার হয়।

কিডনির পাথরে তিলের উপকারিতা
পাথর থাকলে শরীরে তিলের উপকারিতা পাওয়া যায় যদি তিল সঠিকভাবে সেবন করা যায়।
তিল-শুকনো কোমল কোপালের ছায়া (125-250 মিলিগ্রাম) প্রতিদিন খেলে পাথর দ্রবীভূত হয়।
1-2 গ্রাম তিল ফুলের সাথে 2 চা চামচ মধু এবং 250 মিলি দুধ ক্ষারে মিশিয়ে খেলে পাথর দ্রবীভূত হয়।
125-250 মিলিগ্রাম তিল পঞ্চং ভস্ম ভিনেগারের সাথে সকালে খাওয়ার আগে খেলে পাথর দ্রবীভূত হয়।

জরায়ুর ব্যাধিতে তিলের উপকারিতা
ডিম্বাশয়ের ফোলাভাব না কমলে এইভাবে তিল খাওয়া ভালো।
দিনে ৩-৪ বার তিল খেলে জরায়ুর রোগে উপকার পাওয়া যায়।
পিরিয়ডের সমস্যায় ৩০-৪০ মিলি তিলের ক্বাথ খেলে উপকার পাওয়া যায়।
2 গ্রাম শুকনো আদা, 2 গ্রাম কালো গোলমরিচ এবং 2 গ্রাম পিপলের গুঁড়া 100 মিলি তিলের ক্বাথের মধ্যে ছিটিয়ে দিনে তিনবার খেলে মাসিক বা ঋতুস্রাবে উপকার পাওয়া যায়।
তিলের তেলে তুলো ভিজিয়ে যোনিপথে রাখলে লিউকোরিয়া বা সাদা পানিতে উপকার পাওয়া যায়। সাদা পানিতে অর্থাৎ লিউকোরিয়ায় তিলের তেলের উপকারিতা পাওয়া যায়।
1-2 গ্রাম তিলের গুঁড়া পানির সঙ্গে দিনে 3-4 বার খেলে ঋতুস্রাব নিয়মিত হয়।
তিলের ক্বাথ তৈরি করে প্রায় ৩০-৪০ মিলিলিটার ক্বাথ সকাল-সন্ধ্যায় পান করলে ঋতুস্রাব নিয়মিত হয়।

বীর্য সংক্রান্ত রোগে তিল উপকারী
200 মিলি ছাগলের দুধে 5 গ্রাম তিল এবং 1 গ্রাম বাকহুটের গুঁড়া রান্না করে ঠান্ডা করে তাতে মধু মিশিয়ে খেলে বীর্যের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।

তিল মূত্রনালীর রোগের চিকিৎসা করে
প্রস্রাব করার সময় যদি জ্বালাপোড়া হয় তাহলে এইভাবে তিল খেতে হবে।
তাজা তিল পাতা ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে সে পানি পান করলে বা দুধ বা মধুর সঙ্গে ১-২ গ্রাম ক্ষার দিলে পায়েরিয়া এবং মূত্রনালীর সংক্রমণেও উপকার পাওয়া যায়।

আর্থ্রাইটিস থেকে মুক্তি পেতে তিলের উপকারিতা
আজকাল শুধু বয়সের কারণে বাতের সমস্যা হয় না। সারাদিন এসি-তে থাকার কারণে বা বসে বেশি কাজ করার কারণে যে কোনো বয়সেই মানুষ এই রোগের শিকার হতে শুরু করেছে। এ থেকে মুক্তি পেতে তিল এভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
তিল ও শুকনো আদার গুঁড়া সমপরিমাণে মিশিয়ে ৫ গ্রাম করে প্রতিদিন তিন থেকে চারবার খেলে বাত রোগে উপকার পাওয়া যায়।

পুরুষত্বে তিলের উপকারিতা
শরীরে তিলের উপকারের পাশাপাশি এটি পুরুষত্ব বৃদ্ধিতেও উপকারী উপায়ে কাজ করে।
তিল ও তিসির ক্বাথ ৩০-৪০ মিলি করে সকাল-সন্ধ্যা খাবার আগে খেলে পুরুষত্ব বৃদ্ধি পায়।
কালো তিল পিষে ক্যানকার বা আলসারে লাগালে এবং কপিলক জলে ঘষে লাগালে ক্যানসারে উপকার পাওয়া যায়।

বিষের জন্য তিলের ব্যবহার
পানিতে তিল ও হলুদ পিষে মাকড়ের কামড়ানো স্থানে লাগালে মাকড়ের বিষ দূর হয়।
পানিতে তিল পিষে কামড়ানো স্থানে লাগালে বিড়ালের বিষ দূর হয়।
তিলকে ভিনেগার দিয়ে পিষে কামড়ানো স্থানে ঘষলে বার্চের বিষ দূর হয়।
তিলের পিঠা (পিন্যাক) পিষে কামড়ানো স্থানে লাগালে বিছার কামড়ের ব্যথা থেকে উপশম হয়।

জ্বরে জ্বরে তিলের উপকারিতা
জ্বরে তিলের গুঁড়া ঘি দিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

তিলের দরকারী অংশ

আয়ুর্বেদে, তিলের মূল, পাতা, বীজ এবং তেল ওষুধ আকারে বেশি ব্যবহৃত হয়। এসব রোগে তিলের তেল বাহ্যিকভাবে ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়-

প্রতিদিন তিলের তেল দিয়ে মালিশ করলে মানুষ কখনো অসুস্থ হয় না। রক্তের অসুখ, কোমর ব্যথা, মালিশ, বাতের ব্যথার মতো রোগে তিলের তেল মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়।
তিল পিষে পোড়া জায়গায় লাগালে জ্বালাপোড়া ও ব্যথা দূর হয়।
তিল পাতা ভিনেগার বা পানিতে পিষে মাথায় লাগালে মাথাব্যথা দূর হয়।
তিল ও সিডারের ছাল ভিনেগারের সাথে পিষে মুখে লাগালে ব্রণ সেরে যায়।
তিলের পিঠা পানিতে পিষে ঘা ও মচকে বেঁধে দিলে উপকার পাওয়া যায়।
তিল ও ক্যাস্টর আলাদা করে পিষে তিলের তেলে উভয়ই মিশিয়ে লাগালে ঘা ব্যথা দূর হয়।
দুধের সঙ্গে তিল পিষে মাথায় লাগালে মাথা ব্যথায় উপকার পাওয়া যায়।
তিলের বান্ডিল তৈরি করে ক্ষতস্থানে বেঁধে রাখলে ক্ষত দ্রুত সেরে যায়।

হাফথর্ন বা থ্রাশের কাঁটা যদি শরীরের কোনো অংশে প্রবেশ করে এবং তা অপসারণ করতে সমস্যা হয়, তবে সেই স্থানে বারবার তিলের তেল লাগালে কিছুক্ষণের মধ্যে সেই কাঁটা বিনা পরিশ্রমে বেরিয়ে যায়।

তিলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

কুষ্ঠ, ফোলা এবং প্রমেহা অর্থাৎ ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে তিলের বীজ ব্যবহার করা উচিত নয়।

কিভাবে তিল ব্যবহার করবেন
রোগের জন্য তিল সেবন ও ব্যবহারের পদ্ধতি আগেই বলা হয়েছে। আপনি যদি কোনো বিশেষ রোগের চিকিৎসার জন্য তিল ব্যবহার করেন, তাহলে অবশ্যই একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী-
3-6 গ্রাম বীজের গুঁড়া,
10-20 মিলি তেল,
30-40 মিলি ক্বাথ সেবন করা যেতে পারে।

5/5 - (28 votes)

Farhana Mourin

Hi, I’m Farhana Mourin — a passionate writer who loves exploring the worlds of health, beauty, and technology. At Shopnik, I contribute community blog posts that aim to inform, inspire, and make everyday living a little smarter and more beautiful. Whether it’s wellness tips, skincare insights, or the latest tech trends, I enjoy turning complex topics into helpful reads for curious minds.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button