গলা ব্যথা কেন হয় এবং গলা ব্যথা হলে করণীয় কি?
গলা ব্যথার সমস্যা কখনো কখনো মৌসুমি হলেও এটি ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের কারণেও হয়ে থাকে। গলা ব্যথা অনেক রোগের উপসর্গও হতে পারে। যখন একজন ব্যক্তির জ্বর, সর্দি, কানের ব্যথা, গলা বা মুখের ক্যান্সারের মতো গুরুতর অসুস্থতা থাকে, তখন তারও গলা ব্যথা হয়। সঠিক সময়ে এর যত্ন না নিলে রোগটি খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। আপনি কি জানেন যে আপনি ঘরে বসেই গলা ব্যথার সমস্যার সমাধান করতে পারেন।
অনেক আয়ুর্বেদিক প্রতিকার আছে, যেগুলো ব্যবহার করে আপনি গলা ব্যথার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। আসুন জেনে নেই এসব প্রতিকার সম্পর্কে-
Contents [show]
গলা ব্যথা কি?
গলায় প্রদাহের সমস্যা হলে যেটি হয় তা হল গলায় ব্যথা। গলায় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে স্ট্রেপ থ্রোট হয়। গলায় ব্যথা হলে জ্বালাপোড়া, চুলকানির মতো সমস্যা হতে থাকে। খাবার গিলতে গিয়ে ব্যথা আরও বেড়ে যায়।
গলা ব্যথার উপসর্গ–
এগুলি গলা ব্যথার লক্ষণ হতে পারে:-
- চুলকানি
- গিলতে এবং কথা বলার সময় ব্যথা বেড়ে যায়
- খাবার গিলতে অসুবিধা
- গলা শুকিয়ে যাওয়া
- ঘাড়ের গ্রন্থিতে ফোলা ও ব্যথা
- টনসিল ফুলে যাওয়া
- লালভাব
- কণ্ঠে কর্কশতা
- কণ্ঠস্বর মন্থর
- কানের নিচের অংশেও ব্যথা
- ব্যথার কারণে জ্বর হওয়া
- ঘন ঘন হাঁচি
- কাশি
- শ্বাসযন্ত্রে ব্যথা
- ভারসাম্যহীন খাদ্য গ্রহণের ফলে গলা ব্যথা হতে পারে
গলা ব্যথার কারণ
এবার চলুন জেনে নেয়া যাক গলা ব্যথা কেন হয়,
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ-
- স্ট্রেপ থ্রোট- এই সংক্রমণ স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়।
- ডিপথেরিয়া- এটি একটি মারাত্মক শ্বাসযন্ত্রের রোগ।
- হুপিং কাশি বা বুথিং কাশি- এটি শ্বাস নালীর সংক্রমণের কারণে হয়।
ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ–
- হাম- হাম একটি অত্যন্ত সংক্রামক রোগ, এটি সংক্রামিত শ্লেষ্মা এবং লালার সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে।
- চিকেন পক্স ভেরিসেলা -জোস্টার ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট এটি একটি সংক্রামক রোগ।
অন্যান্য কারণ-
- এলার্জি– গলা ব্যথা দেখা দেয় ধুলো, দূষণ ইত্যাদি দ্বারা সৃষ্ট এলার্জি কারণে।
- পরিবেশ– শুষ্ক বাতাসের কারণে গলায় শুষ্কতা, জ্বালাপোড়া অনুভূত হতে পারে।
- চিৎকার– একটি কোলাহলপূর্ণ জায়গা, অন্য ব্যক্তির সাথে অতিরিক্ত কথা বলা এবং বিশ্রাম ছাড়া অবিরাম কথা বলা, গলা ব্যথার কারণ।
- গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স– এটি পাচনতন্ত্রের একটি ব্যাধি, যার কারণে গলায় ব্যথা করে।
- গলা, জিহ্বা, ঘাড়ের নলে টিউমার থাকলে তা গলা ব্যথার কারণ।
- টনসিল– গলার মধ্যে যেখানে নাক ও মুখের ছিদ্র মিলিত হয়, জিহ্বার পিছনের অংশের সাথে যে অঙ্গটি সংযুক্ত থাকে তাকে টনসিল বলে। কোনো কারণে টনসিলে ইনফেকশন বা প্রদাহ হলে অনেক ব্যথা হয়। ব্যথার কারণে অনেক সময় খাবার খেতে বা মুখ খুলতেও অনেক অসুবিধা হয়। টনসিল এর ইনফেকশনের কারণে গলা ব্যথা হয়।
গলা ব্যথা হলে করণীয়
গলা ব্যথা শুরু হলে বা উপসর্গ গুলো দেখা দিলে প্রথমেই আপনার ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করা উচিৎ। চলুন দেখে নিই ঘরোয়া পদ্ধতিতে গলা ব্যথা কমানোর উপায়,
ডালিম খাওয়ার মাধ্যমে- ডালিম গলা ব্যথার জন্য উপকারী। ডালিমের রস খেলে গলা ব্যথা ও ফোলাভাব কমে যায়।
কলা- কলা একটি নরম ও স্বাস্থ্যকর ফল। এটি গলা ব্যথায় উপকার দেয়। এর সেবনে গলা ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
আপেল ভিনেগার- এক কাপ গরম পানিতে এক চামচ আপেল সিডার ভিনেগার এবং এক চামচ লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণটি ধীরে ধীরে পান করুন। শীঘ্রই আপনার গলার প্রদাহ এবং ব্যথা কম হবে।
আরো পড়ুনঃ ওজন কমাতে আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার নিয়ম, লেবুর উপকারিতা ও অপকারিতা, স্বাস্থ্যের জন্য মধু খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
লেবু- লেবু গলা ব্যথা বা গলার রোগ থেকে মুক্তি দেয়। এর জন্যে এক কাপ গরম পানিতে অর্ধেক লেবু ছেঁকে গার্গলিং করুন। অথবা লবণ ও গোলমরিচ যোগ করে অর্ধেক লেবু খেতে পারেন।
দারুচিনির ব্যবহার– গলা ব্যথা বা গলার রোগে দারুচিনি উপকারী। এক গ্লাস গরম পানিতে এক চা চামচ দারুচিনি গুঁড়া এবং এক চা চামচ কালো গোলমরিচের গুঁড়া মিশিয়ে নিন। এটি ফিল্টার করুন এবং দিনে ২-৩ বার পান করুন। এতে গলা ব্যথার রোগে উপকার পাওয়া যাবে।
লবণ- গলা ব্যথার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে ভালো এবং সহজ উপায় হলো লবণ পানি দিয়ে গার্গল করা। লবণ পানি একটি অ্যান্টিসেপটিক হিসাবে কাজ করে এবং শ্লেষ্মা আলগা করতে সাহায্য করে। এটি কফ কমায় এবং প্রদাহ থেকে দ্রুত মুক্তি দেয়।
রসুন– রসুনের অ্যান্টিসেপটিক গুণ গলা ফোলা কমায় এবং ব্যথা নিরাময় করে।
হলুদ- এক গ্লাস গরম পানিতে এক চা চামচ হলুদ মিশিয়ে নিন। সকালে খালি পেটে এই মিশ্রণটি ধীরে ধীরে পান করুন। এর অ্যান্টিসেপটিক বৈশিষ্ট্য প্রদাহ কমায়। হলুদের ঔষধিগুণ গলা ব্যথা বা মাম্পসের সমস্যা কমাতে খুবই উপকারী।
মেথির উপকারিতা– গলায় ফোলাভাব থাকলে মেথির ব্যবহার খুবই উপকারী। মেথির বীজে উপস্থিত শ্লেষ্মা উপশমকারী বৈশিষ্ট্যগুলি গলা ব্যথা এবং ফোলা কমায়।
লবঙ্গ– লবঙ্গ একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ভেষজ। এক কাপ গরম পানিতে এক বা তিন চা চামচ লবঙ্গ গুঁড়া বা লবঙ্গ মিশিয়ে নিন। এটা পান করলে গলা ব্যথায় উপশম পাওয়া যায়।
টমেটো– টমেটোর রসে লাইকোপিন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা গলা ব্যথায় উপশম করতে সাহায্য করে।
অ্যালুমের উপকারিতা- ১ গ্লাস উষ্ণ জলে ২০০ গ্রাম অ্যালুম ফিল্টার করে কুলি করুন। এটির ব্যবহার গলা ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়।
গ্রিন টি- অনেক রোগের চিকিৎসায় গ্রিন টি ব্যবহার করা হয়। এটি গলার সংক্রমণ বা অ্যালার্জি প্রতিরোধে কাজ করে। দিনে দুই বার গ্রিন টি পান গলা ব্যথার চিকিৎসায় খুবই সহায়ক।
গলা ব্যাথা রোগে আপনার জীবনধারা কেমন হওয়া উচিত?
পুষ্টিকর খাবার খাবেন।
যতটা সম্ভব তরল পান করুন যাতে আপনার গলা শুকিয়ে না যায়। প্রচুর পানি পান করতে হবে।
এক গ্লাস পানি হালকা গরম করুন। এতে এক চা চামচ লবণ দিন। এই পানি দিয়ে গার্গল করুন। এতে করে গলা ব্যথায় উপকার পাওয়া যায়। সর্বোচ্চ বিশ্রাম নিন।
গলায় ব্যথার পাশাপাশি নাক বন্ধ থাকলে ঘুমানোর সময় ঘাড়ের নিচে বালিশ রাখুন, যাতে শ্বাস নিতে কোনো অসুবিধা না হয়।
আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন এবং খাবার খাওয়ার আগে হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করুন।
আপনার মুখ পরিষ্কারের যত্ন নিন। খুব বেশি জিহ্বা পরিষ্কার করবেন না। অতিরিক্ত ঘষলে জিভের খোসা ছাড়তে পারে, যার ফলে গলা ব্যথা হতে পারে।
একে অপরের অবশিষ্টাংশ খাবেন না।
চিৎকার করা এড়িয়ে চলুন, অন্যথায় গলা ব্যথা হতে পারে।
চামচ এবং কাচের মতো একই পাত্র না ধুয়ে ব্যবহার করবেন না।
কমলালেবু এবং অন্যান্য রস এবং ফল বেশি এসিডিক হলে এবং এটি সেবন করলে গলা ব্যাথা বেড়ে যায়।
ভিনেগার ও লবণ দিয়ে তৈরি খাবার একেবারেই খাওয়া উচিত নয়। এগুলি গলা ব্যথার অবস্থাকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে।
যাদের গলা ব্যথা আছে, তাদের একেবারেই অ্যাসিডিক প্রকৃতির সবজি যেমন টমেটো ইত্যাদি খাওয়া উচিত নয়।
মরিচ, সস এবং জায়ফলের মতো মশলা গলা ব্যথাকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে ।
পানীয় এবং মাউথ ফ্রেশনার বা মাউথওয়াশ যাতে অ্যালকোহল থাকে। তারা সংক্রামিত গলায় একটি দমকা সংবেদন সৃষ্টি করতে পারে।
অ্যালকোহল সেবনের ফলে শরীরে পানি কমে যায়। অতএব, যাদের গলা ব্যথা আছে তাদের জন্য এটি মোটেও ভালো নয়।
যারা ধূমপান করেন, তাদের উচিত কিছু সময়ের জন্য ধূমপান, তামাক ইত্যাদি ত্যাগ করা।
ঠান্ডা যেমন ঠান্ডা পানীয়, আইসক্রিম ইত্যাদি সেবন করবেন না।
জোরে কথা বলবেন না।
জাঙ্ক ফুড যেমন পিৎজা, বার্গার ইত্যাদি খাবেন না।
ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল সেবন করবেন না। এটি আপনার গলার সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং শরীরে পানিশূন্যতা হতে পারে।
উপরের ব্যবস্থাগুলো যদি সাহায্য না করে তাহলে এর কারণ কী হতে পারে?
যদি আয়ুর্বেদিক প্রতিকার সাহায্য না করে, তাহলে এর মানে হল যে, গলার সংক্রমণ এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে ঘরোয়া প্রতিকারে তা নিরাময় করা যাবে না।
কখন একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবেন?
ভাইরাল সংক্রমণের কারণে গলা ব্যথা সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে নিজেই চলে যায়, তবে ঘরোয়া প্রতিকারগুলি কাজ না করলে আপনার ডাক্তারের সাথে দেখা করা উচিত। নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে আপনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে-
* যখন ব্যথা খুব বেশি হয়
* খাবার এবং তরল গিলতে অসুবিধা।
* গর্ভাবস্থায় গলা ব্যথা।
* শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
* মুখ থেকে লালা বের হতে থাকে।
* আপনি যখন ডিহাইড্রেশনের লক্ষণগুলি অনুভব করেন।
* যখন আপনার কানে ব্যথা হয়।
* ব্যথায় ঘুমাতে পারছে না, ঘুমের সমস্যা হচ্ছে
* থুথুতে রক্ত দেখা দিলে।
এই পরিস্থিতিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন ডাক্তার এর সাথে পরামর্শ করতে হবে।
আরো পড়ুনঃ